কালবোশেখির কারিশমা না গাফিলতির মাশুল?

২২ এপ্রিল বিকেলে ঢাকায় বেদম ঝড়বৃষ্টি হয়। এর আগে ১৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা কালবৈশাখীর তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। কলকাতায় মারা যায় আটজন আর আশপাশের জেলাগুলোয় আরও ১০ জন। কলকাতায় ঝড়ের গতিবেগ ছিল গত পাঁচ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৮৪ কিলোমিটার পর্যন্ত গতিতে বয়ে যাওয়া সেই ঝড় দু-এক জায়গায় নাকি ঘণ্টায় প্রায় ৯৮ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে। ঢাকায় ২২ এপ্রিলের ঝড় ঘণ্টায় ৮৩ কিলোমিটার বেগের ছিল বলে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে। আবহাওয়া পণ্ডিতেরা কালবৈশাখীকে তিনটা মাত্রা দিয়ে ভাগ করেন: হালকা, মাঝারি আর ভারী। বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৬১ থেকে ৯০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকলে সেটা হালকা ঝড়, ৯১ থেকে ১২০ কিলোমিটার বেগে বয়ে গেলে সেটা মাঝারি আর ১২১ থেকে ১৪৯ কিলোমিটারের ঝড়কে ভারী বা প্রচণ্ড ঝড় হিসেবে গণ্য করা হয়। হিসাবের এই পাল্লা অনুযায়ী ঢাকার ঝড়টি হালকা আর কলকাতার ঝড়টি মাঝারি আকারের বলে নথিবদ্ধ করতে হবে।

ঝড়ের সময় যাঁরা ঢাকার রাস্তায় ধানমন্ডি, কলাবাগান বা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ছিলেন, তাঁরা এই কালবৈশাখীকে কোনোমতেই হালকা ঝড় বলে কবুল করবেন না। এখন পর্যন্ত প্রাণহানির কোনো খবর বা গুজব শোনা যায়নি, তবে জনা পঞ্চাশেক মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এখন পর্যন্ত প্রায় ২০ জন ভর্তি আছেন নানা হাসপাতালে। তাহলে কি ঝড়ের বেগ মাপার কলকবজা বিগড়ে গেছে, তাই উল্টাপাল্টা হিসাব দিচ্ছে? ঝড়ের বেগ মাঝারির ওপরে না গেলে এত বড় বড় গাছ উপড়ে পড়ল কেমন করে। যাঁরা গাছপালার খোঁজখবর রাখেন, উদ্ভিদবিজ্ঞানে জানাশোনা আছে, তাঁরা জানেন, ১০০ কিলোমিটার বেগে ঝড় না হলে কোনো গাছ উপড়ে পড়ে না। কলাগাছ, পেঁপেগাছ উপড়াতেও ৮০ থেকে ৮৫ কিলোমিটার বেগের ঝড়ের প্রয়োজন হয়। মানিক মিয়ার পাট গবেষণা আর কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের চৌহদ্দিতে থাকা কলাগাছ, পেঁপেগাছ বেঁচে গেল আর মানিক মিয়ায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সেয়ানা সেয়ানা গাছ একেবারে উপড়ে গেল? গণভবনের পাশে আর সংসদ ভবনের উত্তর প্লাজার মাঝে থাকা বড় বড় চম্বল আর গুলমোহর (যাকে আমরা ভুল করে কৃষ্ণচূড়া বলি) ধপাধপ পড়ে গেল। মানুষ আহত হলো। গাড়ি চাপা খেল? এর পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র চক্কর বা জাদুটোনা রহস্য কাজ করছে কি? কলকাতার প্রশাসন একটু গোলক ধাঁধায় পড়েছে। তবে সেখানে জবাবদিহি গণতন্ত্র চর্চা আর জানার আগ্রহ প্রবল থাকায় পণ্ডিতেরা ঝড়ের ময়নাতদন্তে নেমেছেন। ১০০ কিলোমিটারের চেয়ে কম বেগের ঝড়ে ইয়া বড় বড় আজদাহা সাইজের গাছ উপড়ে পড়ার রহস্যটা কী? ঢাকাবাসী খেয়াল করলে দেখবেন, যেসব গাছ উপড়ে পড়েছে, সেসব গাছের বেশির ভাগই রাস্তার ধারে ফুটপাতে বা রাস্তার মাঝে আইল্যান্ডে লাগানো (লাগানো না বলে বসানো বলাই ভালো)। মানিক মিয়ার কংক্রিটের বিছানায় কয়েকটা ইট গেঁথে রাতারাতি আইল্যান্ডের খোল বানিয়ে মাটি আর ভিটা বালু দিয়ে ভরাট করে জাত-কুল বিচার না করে সারি সারি গাছ লাগিয়ে চমক দেখানো বরং মানুষের যন্ত্রণা বাড়াচ্ছে।

গণভবনের আর সংসদ ভবনের দক্ষিণে উপড়ে পড়া বেশির ভাগ গাছই বিশাল চম্বলগাছ। এগুলো মূলত চা-বাগানের ছায়া তৈরির জন্য এ দেশে আনা হয়। লোকালয়ে বা রাস্তার পাশে লাগানোর গাছ এগুলো নয়। সিডরে বেশির ভাগ মানুষই আহত নিহত হয়েছিল এই চম্বলগাছের চাপায়। এই গাছের শিকড় মাটির গভীরে যায় না। কিন্তু ঝাঁকড়া মাথার কারণে অনেক ছায়া পাওয়া যায়। মাটির রস কম খেয়ে বেশি ছায়া দেয় বলে চা-বাগান মালিকদের এই গাছ ছিল এক নম্বর পছন্দের। তাড়াতাড়ি বাড়ে আর চটজলদি মোটা হয়ে যায়, তাই গাছ লাগিয়ে লাভবান হওয়ার তাগিদে এই গাছ চলে এসেছে লোকালয়ে। গুলমোহর বা কৃষ্ণচূড়াও আমাদের রাস্তাঘাট আর বাড়ির আঙিনার জন্য উপযুক্ত গাছ নয়। মাদাগাস্কার থেকে ব্রিটিশরা এই গাছ নিয়ে এসেছিল রেলস্টেশনের পেছনে আর প্ল্যাটফর্মে লাগানোর জন্য। এই গাছের শিকড়ও মাটির গভীরে যায় না, তাই অল্প ঝড়েই উল্টে পড়ে।

রাস্তার পাশে সহজে উপড়ে পড়ার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে কারণে-অকারণে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। পশ্চিমবঙ্গের বনমন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলেছেন, রাস্তা যেভাবে কাটা হচ্ছে, তাতে গাছের শিকড়ও কেটে যাচ্ছে। রাস্তা, ফুটপাত খোঁড়াখুঁড়ির কাজে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

ঢাকার নগরপালদের এদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। নগরে উপযুক্ত দেশি গাছের দিকে মন দিতে হবে। ২২ তারিখের ঝড়ে শহরের একটিও ছতিম, কাঠবাদাম, নারকেল, খেজুর, তাল, কদম, শিমুল, বকুল, জারুল, সোনালু, অশোকগাছ উপড়ে পড়েছে কি? উপড়ে পড়েছে ইপিলইপিল, একাশিয়া, চম্বল, কৃষ্ণচূড়া নামের দূর দেশ থেকে নিয়ে আসা গাছ। মাটির নিচে শিকড় বিস্তারের সুযোগ না দেওয়া গাছ।

নগরে গাছ নির্বাচন আর লাগানো ও পরিচর্যার একটা বাস্তবায়নযোগ্য বিধিমালা নগরবাসীকে নিয়ে তৈরি করা প্রয়োজন। এমন গাছ লাগাতে হবে যে গাছ ঝড়ের দু-একটা ঝাপটা সামলাতে পারবে। নিরুপায় মানুষ হঠাৎ বৃষ্টি দেখলে নিরাপদ গাছের নিচে একটু দাঁড়াতে পারবে। নগরীর বাস্তুহারা পাখিরা ঠাঁই পাবে, নীড় বাঁধবে, খাবার পাবে। পাখি না থাকলে নগর থাকে না। ঠিক গাছ না থাকলে পাখিও থাকে না।

গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক