অভ্যুত্থানে রুহানিকে উৎখাত সম্ভব?

প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। ছবি: রয়টার্স
প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। ছবি: রয়টার্স

বছরের শুরু থেকেই একের পর এক বিক্ষোভ প্রত্যক্ষ করছে ইরান। শুধু জানুয়ারিতেই ২৯টি প্রদেশের ৮০টি শহরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। এসব বিক্ষোভ চলার সময় সহিংসতায় কমপক্ষে ২১ জন মারা গেছে। তেহরানে হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করার বিরুদ্ধে ফেব্রুয়ারির শুরুতে হিজাব খুলে বিক্ষোভ করার জন্য কয়েক ডজন নারীকে আটক করা হয়। ওই মাসেরই শেষ দিকে গোনাবাদী সুফি মতাদর্শে বিশ্বাসী বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয় এবং পুলিশ প্রায় ১০০ জন গোনাবাদীকে আটক করে।

ইরানের জাতিগত বৈচিত্র্য নিয়ে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে আরবদের বাদ দেওয়ায় মার্চ মাসের শেষ দিকে খুজেস্তান প্রদেশে আরবরা সরকারবিরোধী বিক্ষোভ করে। এরপর এপ্রিলে ইস্ফাহান প্রদেশে পানির সংকট নিয়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে পুলিশ অভিযান চালায়। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রদেশে শ্রমিক আন্দোলন লেগেই আছে।

এসব বিক্ষোভের বাইরে এই ইসলামি প্রজাতন্ত্র মুদ্রার মান দ্রুত পড়ে যাওয়া, খরা পরিস্থিতির অবনতি, সিরিয়ায় সামরিক সংশ্লিষ্টতা গভীরতর হওয়াসহ নানা আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যায় রয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানের সামর্থ্য এই মুহূর্তে সরকারের নেই। এই অস্থিতিশীলতার মধ্যে ক্ষমতাসীন সরকারকে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে উৎখাত করা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। ইতিমধ্যে এমন কিছু লক্ষণ দেখা দিয়েছে, যাত মনে হচ্ছে আয়াতুল্লাহ খামেনির নির্দেশ পেলেই ইরানিয়ান রেভল্যুশনারি গার্ড করপস (আইআরজিসি) পদক্ষেপ নেবে।

বড় ধরনের সংস্কারই বিদ্যমান সংকটের সমাধান দিতে পারে বলে ইরানের প্রভাবশালী রাজনীতিকদের যে অংশ মনে করে, তাদের মধ্যে উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু আপাতত সংস্কার একেবারেই সম্ভব নয় বলে মনে হচ্ছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্টসহ নির্বাচিত পর্ষদগুলোর ক্ষমতা এত সীমিত যে দেশটিতে যেকোনো ধরনের অর্থবহ পরিবর্তন আনতে তারা একেবারেই অক্ষম। অন্যদিকে সর্বোচ্চ নেতা, বিচার বিভাগ, নিরাপত্তা বিভাগসহ বিভিন্ন অনির্বাচিত কর্তৃপক্ষ সীমাহীন ক্ষমতা ভোগ করছে। তারা মনে করছে, বিদ্যমান সমস্যার সমাধান না হওয়ার জন্য নির্বাচিত সরকারের অযোগ্যতাই দায়ী।

ইরানের ‘পলিটিক্যাল ক্যাপিটাল’ প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সঙ্গে সর্বোচ্চ নেতার সম্পর্ক শীতলতর হয়েছে। পরমাণু ইস্যুতে পশ্চিমাদের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছানো এবং আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া সহজ হবে মনে করে খামেনি একজন উদারপন্থী নেতা চেয়েছিলেন। সেদিকে লক্ষ রেখে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে হাসান রুহানিকে মনোনীত করেছিলেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হয়নি, বরং যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে এবং নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাঁয়তারা করছে। অন্যদিকে, অর্থবহ পরিবর্তনে প্রত্যাশী ইরানিদের কাছেও রুহানির জনপ্রিয়তা কমে গেছে।

পরিস্থিতির যদি অবনতি হয় এবং ধর্মীয় শাসনব্যবস্থা যদি হুমকির মুখে পড়ে, তাহলে রুহানি প্রশাসনকে খামেনি উৎখাত করার আদেশ দিতে পারেন। দেশটির কট্টরপন্থীরা মনে করেন, ইরানের যে সমস্যা, তা উদারপন্থা দিয়ে সমাধান করা সম্ভব হবে না। কট্টর অবস্থানে থেকেই পশ্চিমাদের মোকাবিলা করতে হবে। এ অবস্থায় উদারপন্থীদের সরিয়ে কট্টরপন্থীদের বসানো ঠিক হবে কি না, তা খামেনিকেই ঠিক করতে হবে।

সর্বাধিনায়ক হিসেবে আইআরজিসি, স্বেচ্ছাসেবী মিলিশিয়া বাহিনী বাসিজ, সেনাবাহিনীসহ ইরানের সব সশস্ত্র শক্তির নিয়ন্ত্রণ খামেনির হাতে। এর মধ্যে বিশেষ করে আইআরজিসি ও বাসিজ আয়াতুল্লাহ খামেনির প্রতি বেশি অনুগত। সম্প্রতি এসব প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক নেতৃত্বে কিছু অস্বাভাবিক পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা দেখে মনে হচ্ছে, খামেনি সম্ভাব্য কোনো অভিযানে আইআরজিসিকে নামানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

মার্চের শুরুতে আইআরজিসিতে একসময় খামেনির প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী হোজ্জাত আল ইসলাম আল সাঈদীকে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীতে খামেনির প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। নতুন এই পদে যোগ দেওয়ার সুবাদে সাঈদী সশস্ত্র বাহিনীর সব শাখার সব আদর্শিক ও রাজনৈতিক ব্যুরোর নিয়ন্ত্রণ পেয়েছেন। আইআরজিসিতে তাঁর ডেপুটি হিসেবে রয়েছেন আবদুল্লাহ হাজি সাদেঘি, যিনি খামেনির একান্ত অনুগত হিসেবে পরিচিত।

গত মার্চে সাঈদীর আরেক সাবেক উপদেষ্টা ও খামেনিভক্ত জেনারেল ইয়াদোল্লাহ জাভানিকে আইআরজিসির পলিটিক্যাল ডেপুটি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব নিয়োগ থেকে বোঝা যায়, খামেনি সামরিক বিভাগকে নিজের হাতের মুঠোয় নিতে চাইছেন, যাতে প্রয়োজন দেখা দিলে তিনি তাদের ব্যবহার করতে পারেন।

মনে হচ্ছে, দুটির যেকোনো একটি কারণে খামেনি আইআরজিসিকে কবজায় রাখতে চাইছেন। প্রথমত, পরিস্থিতির অবনতি হলে তিনি সেনাবাহিনীকে দিয়ে প্রেসিডেন্ট রুহানিকে সরিয়ে দেবেন। আর যদি পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকে, তাহলে রুহানিকে তাঁর মেয়াদ শেষ করতে দেবেন এবং পরে সেনাবাহিনীর কাউকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় বসাবেন।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

সাঈদ গোলকার: যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক