জাতিসংঘ প্রতিনিধিদলের সফর

বাংলাদেশের প্রায় সব বন্ধুরাষ্ট্রের তরফে ক্রমাগত আমরা এই আশ্বাস পেয়ে আসছি যে রোহিঙ্গা সংকটে তারা বাংলাদেশের পাশে রয়েছে। একই সঙ্গে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রতিক জাতিগত নিধন থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ায় তারা বাংলাদেশের প্রশংসাও করছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই সংকটের সমাধান, বিশেষ করে শরণার্থীদের যথাযথভাবে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কার্যকরভাবে পাশে পাচ্ছে না। ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ ও কৌশল নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা জরুরি হয়ে পড়েছে। আরও জোরালো কূটনৈতিক উদ্যোগ ও কঠোর অবস্থানের কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।

আমরা দেখছি যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই চুক্তি বাস্তবায়নে অব্যাহতভাবে টালবাহানা করে যাচ্ছে। গত নভেম্বর মাসে চুক্তি সইয়ের পর পাঁচ মাস পার হয়ে গেলেও শরণার্থী প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে কার্যকর কোনো অগ্রগতি এখনো লক্ষণীয় নয়। এটা এখন অনেকটাই পরিষ্কার যে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরকে তারা রোহিঙ্গা প্রশ্নে আন্তর্জাতিক চাপ এড়ানো এবং এই ইস্যু থেকে নজর সরানোর একটি কৌশল হিসেবে নিয়েছিল। তাদের সেই কৌশল পুরোপুরি সফল না হলেও চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে তারা সময়ক্ষেপণের একটি সুযোগ পেয়েছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সরকার তাদের রোহিঙ্গাবিরোধী অবস্থান পরিবর্তনের কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ সফল হওয়ারও সুযোগ নেই। সবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি এখন যেখানে গিয়ে ঠেকেছে তাতে দেশটির ওপর আন্তর্জাতিকভাবে অবরোধসহ কঠোর চাপ প্রয়োগ করতে না পারলে শরণার্থী প্রত্যাবাসন সফল হবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশকে এখন সেই দিকেই মনোযোগী হতে হবে।

দ্রুত এ ধরনের কিছু করতে ব্যর্থ হলে একসময় সমস্যাটির ওপর থেকে খুব স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাতিক নজর সরে যাবে এবং রোহিঙ্গারা চিরস্থায়ী উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশকে একদিকে যেমন এই বিপুল জনগোষ্ঠীর চাপ বয়ে যেতে হবে, তেমনি নিরাপত্তার ঝুঁকির মধ্যেও পড়তে হবে।

আশার কথা যে সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে নতুন করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নড়াচড়া শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়নের অভিযোগ তদন্ত করতে শুরু করেছে। সুদানের দারফুরের হত্যাযজ্ঞের পর যুক্তরাষ্ট্র যে মডেল অনুসরণ করে তদন্ত করেছিল, রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা-নিপীড়নের অভিযোগ তদন্তেও তারা একই মডেল অনুসরণ করছে। দারফুরের ঘটনার তদন্তের পর ফলাফলের ভিত্তিতে সুদান সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক অবরোধ আরোপ করেছিল। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের এই তদন্তের বিষয়টি মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে পারে।

তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদলের আসন্ন সফরটিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করতে হচ্ছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের এই প্রতিনিধিদলটি শনিবার বিকেলে বাংলাদেশ সফরে আসছে। তারা রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরও পরিদর্শনে যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সোমবার দলটি মিয়ানমারের উদ্দেশে রওনা হবে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদলের এই সফর নিশ্চিতভাবেই আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করবে এবং রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে নতুন করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরার একটি সুযোগ তৈরি হবে। আমরা আশা করব, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদলের এই সফরকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকটের একটি স্থায়ী ও কার্যকর সমাধানের পরিস্থিতি তৈরি কাজে লাগাতে পারবে।