অভিনন্দন পরীক্ষার্থী, বোর্ড আর সরকারকে

এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্র ফাঁসের কবলে পড়তে হয়নি
এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্র ফাঁসের কবলে পড়তে হয়নি

সরকারকে অভিনন্দন। অভিনন্দন শিক্ষামন্ত্রীকে। ধন্যবাদ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সবাইকে। তাঁরা শেষ পর্যন্ত একটি প্রশ্নপত্র ফাঁসমুক্ত পরীক্ষা উপহার দিতে পেরেছেন। গতকাল আমার ভাতিজির উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার তত্ত্বীয় অংশ শেষ হয়ে গেল। এরপর শুধু ব্যবহারিক পরীক্ষা থাকবে। অভিনন্দন এই জন্য যে এবার আমার ভাতিজিকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কবলে পড়তে হয়নি।

কারও কারও আরও দু-একটা পরীক্ষা হয়তো বাকি আছে। আশা করি, তাদেরও আর কোনো হয়রানির শিকার হতে হবে না। আমরা কিন্তু বহুদিন থেকেই বলে আসছিলাম, একাধিক সেট প্রশ্নপত্র তৈরি করুন। আর পরীক্ষার আগে আগে এসএমএস করে, ফোন করে, অনলাইনে জানিয়ে দিন, আজ কোন সেটে পরীক্ষা হবে। এবার সেই কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে এবং তার সুফল পাওয়া গেছে। ভবিষ্যতে এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যাবে। আরও বেশিসংখ্যক সেট প্রশ্নপত্র তৈরি করে রাখা উচিত হবে।

আপনারা বলতে পারেন, এতে সরকার বা শিক্ষামন্ত্রীকে কেন অভিনন্দন জানাতে হবে। সরকারের কাজই তো ভালো কাজ করা। তা সত্য। কিন্তু ভালো কাজকে যদি আমরা উৎসাহিত না করি, তাহলে আরও ভালো কাজ করতে কেউই প্রণোদনা পাবে না। সত্য বটে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, এই সাধারণ কথাটা স্বীকার করাতেও আমাদের বহু বেগ পেতে হয়েছে। এই সমস্যা সমাধানে সরকারকেও বহুবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছে। কারণ, যোগাযোগের অভাবনীয় উন্নতি। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, বাছাই, ছাপানো, কেন্দ্রে কেন্দ্রে পাঠানো, এই শিকলটা অনেক বড়। হাজার হাজার মানুষ জড়িত। যেকোনো একটা পর্যায়ে একজনও যদি প্রশ্নপত্র দেখার সুযোগ পায়, অমনি সে ছবি তুলে ফেলবে। তারপর সেটা সে একবার যদি কাউকে দেয়, এটা দাবানলের চেয়েও দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছিলেন, দেশ হয়ে গেছে ডিজিটাল, পরীক্ষাপদ্ধতি রয়ে গেছে অ্যানালগ, অ্যানালগ পদ্ধতি দিয়ে ডিজিটাল সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এবার ডিজিটাল যুগের বুদ্ধিই গ্রহণ করা হয়েছে, ছাত্রছাত্রীদের হলে বসিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে, কোন সেটে পরীক্ষা হবে।

২.
৬ মে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেরোবে। ৭ মের পত্রিকায় আমরা ভালো ফল করা ছেলেমেয়েদের হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখতে পাব। ভাবতেই এখনই আমার মনটা ভালো হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের জনপদে জনপদে কিন্তু ‘আশা’ দেখা দিয়েছে। প্রায় ৯৯ ভাগ ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়, হাজার হাজার ছেলেমেয়ে জিপিএ ফাইভ পায়। খুব সাধারণ ঘরের, খেটে খাওয়া মানুষের ছেলেমেয়েরাও ভালো ফল করে। প্রথম আলোর ভাষায় এরা অদম্য মেধাবী। আজকে কুড়িগ্রামের চরের কৃষকের, সুন্দরবনের মৌয়ালের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, ভালো ফল করছে। তাঁরা সবাই আশায় বুক বেঁধে আছেন, তাঁদের ভাগ্য ফিরবে শিক্ষা নামের এই পরশমণির ছোঁয়ায়। একটা ট্রেন যে এগিয়ে যায়, কারণ তার থাকে একটা ইঞ্জিন, একটা জাতি যে এগিয়ে যায়, কারণ তার সামনে থাকে আশা। বাংলাদেশ হাজারো প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে, যদি এই আশাটা আমরা বজায় রাখতে পারি। মানুষ নিজের চেষ্টায় এগোবে, এগিয়ে যাবে দেশ। এই আশা অটুট রাখার জন্যই কোটাপদ্ধতি জটিলতার সুন্দরতম সমাধান চাই। এটা করলে সরকারও তার মার্কসশিটে আরও নম্বর পাবে।

৩.
যারা মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো করবে, তাদের আগাম অভিনন্দন। যেকোনো পরীক্ষায় ভালো করার মূল্য অপরিসীম। তবে মনে রেখো, মাধ্যমিক পরীক্ষা জীবনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। মাধ্যমিকের চেয়ে কঠিন উচ্চমাধ্যমিক। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ পরের ধাপগুলো।

আমি যেখানেই যাই, দুটো পরামর্শ স্কুলের ছেলেমেয়েদের দিই। এক. পাঠ্যবই ঠিকমতো পড়ো। প্রশ্নের উত্তর শেখার জন্য নয়, পরীক্ষায় ভালো করার কৌশল রপ্ত করার জন্য নয়, শুধু আনন্দের জন্য পড়ো। এমনকি যেসব গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা বইয়ের যেসব অংশ সিলেবাসে নেই, সেসবও পড়ো। দুই. গণিত বইয়ের অনুশীলনী অংশে সরাসরি যাবে না, প্রথমে অনুশীলনীর আগে যে লেখাগুলো থাকে, যে বিবরণ থাকে, সেগুলো পড়ো। বোঝার চেষ্টা করো। তারপর অনুশীলনীতে যেয়ো।

আমাদের একটা দুশ্চিন্তা হলো জিপিএ ফাইভ পাওয়ার লড়াইয়ে ছেলেমেয়েদের জীবন পরীক্ষাময় হয়ে গেছে। তারা শেখার জন্য নয়, পরীক্ষায় ভালো করার জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করছে। কোচিং সেন্টারের প্রাদুর্ভাবও সেই কারণে। সেই একই কারণে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটছে। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু ভালো ফল নয়, এমনকি জুড়িগাড়ি চড়াও নয়, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন, যোগ্যতা অর্জন, দক্ষতা অর্জন, খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন। মনের দিগন্তকে বড় করা, ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে ওঠা, মানবিক হওয়া, মানুষ হওয়া, সুন্দর মানুষ হওয়া।

৪.
যারা জিপিএ ফাইভ পাবে না, তাদের বলব, তোমরা একদম হতাশ হবে না। আমাদের ক্লাসে এ সেকশনে আমরা ছিলাম ৫০ জন, কেউ ক্লাসে প্রথম হতো, কেউবা হতো দ্বিতীয়, কেউবা শেষতম স্থানে গিয়ে পড়ত, পাস করতে পারত না। আজকে স্কুল ছাড়ার ৩৭ বছর পর বলতে পারি, সবাই ভালো করছে। যে প্রথম হতো সে-ই কি সবার চেয়ে ভালো করছে? তা নয়।

আইনস্টাইন বলেছেন, জীবন হলো বাইসাইকেলের মতো, সব সময় চালাতে হয়, তা না হলে তুমি পড়ে যাবে। আর কবি রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন, ‘জীবন চলেই যায়।’ সবার জীবন চলে যাবে। আমি বারবার বলি, জীবন সবার জন্য সোনার মেডেল রেখে দিয়েছে, শেষ ফিতাটা পর্যন্ত তুমি দৌড়ে যেয়ো, হাল ছেড়ো না।

জীবনের ফলের সঙ্গে পরীক্ষার ফলের মিল খুব কম। পরীক্ষার ভালো ফল তোমাকে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় ভর্তি হওয়ার সুযোগ করে দেয়, কাঙ্ক্ষিত পেশা বেছে নেওয়ার যোগ্য করে তোলে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে কেবল ভালো ছাত্ররাই জীবনে ভালো করে। একবার আমি একটা মেয়েদের স্কুলে বললাম, কে কে ডাক্তার হতে চাও। প্রায় নব্বই ভাগ ছাত্রী হাত তুলল। সবাই ডাক্তার হলে তো চলবে না। সবাই বিজ্ঞান পড়লেও চলবে না, সবাই ব্যবসায় পড়লেও না, সবাই কম্পিউটার পড়লেও না, সবাই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লেও না। বাংলায় পড়লেও তুমি ভালো করতে পারো। আমাদের প্রিয়তম দুই শিক্ষক আনিসুজ্জামান ও আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাংলায় পড়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তো বাংলার ছাত্রী ছিলেন। এমনকি তুমি যদি ফারসি পড়ো, সুন্দর সুন্দর ফারসি লেখা যদি আমাদের বাংলায় অনুবাদ করে দাও, আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।

আমরা আসলে সুন্দর মানুষ চাই। ভালো মানুষ চাই। সে জন্য তোমাদের কী করতে হবে।
স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আইনস্টাইন বলে গণ্য বিশ্বখ্যাত প্রকৌশলী ফজলুর রহমান খান বলেছেন, ‘একজন প্রযুক্তিবিদের আপন প্রযুক্তিতে হারিয়ে যাওয়া উচিত নয়, তাকে অবশ্যই জীবন উপভোগ করতে পারতে হবে, আর জীবন হলো শিল্প, সংগীত, নাটক; এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, জীবন হলো মানুষ।’ বিল গেটস বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার ছিল অনেক স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন আমি পেয়েছি বই থেকে।’ আমাদের প্রচুর বই পড়তে হবে। পাঠ্যবইয়ের বাইরেরও অনেক বই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, পৃথিবীর পুস্তক সাধারণকে পাঠ্যপুস্তক ও অপাঠ্য পুস্তক, প্রধানত এই দুই ভাগে বিভক্ত করা যাইতে পার। টেক্সট বুক কমিটি হইতে যে-সকল গ্রন্থ নির্বাচিত হয় তাহাকে শেষোক্ত শ্রেণিতে গণ্য করিলে অন্যায় বিচার করা যায় না।

কাজেই পড়ো, প্রচুর বই পড়ো, সংস্কৃতির চর্চা করো, খেলাধুলা করো, সেবামূলক কাজ করো, নিজেকে মাদকমুক্ত রাখো। দেশপ্রেমিক ও মানবপ্রেমিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলো। এই বিশাল বিরূপ পৃথিবীতে চলার, লড়াই করার দক্ষতা অর্জন করো, সুন্দর মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলো। তুমিই হবে আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষ, তা তুমি জিপিএ ফাইভ পেলে কি পেলে না, তাতে কিছু যাবে-আসবে না।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক