কার্ল মার্ক্সের দেশে ফেরা ও বিভক্ত জার্মানি

মার্কসের ২০০ তম জন্মদিনে চিনের উপহার দেয়া ১৫ ফুট উচ্চতার ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য বসানো হয় মার্কসের জন্মশহর ট্রিয়ার্সে, তাঁর বাড়ির সামনে। ছবি রয়টার্স
মার্কসের ২০০ তম জন্মদিনে চিনের উপহার দেয়া ১৫ ফুট উচ্চতার ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য বসানো হয় মার্কসের জন্মশহর ট্রিয়ার্সে, তাঁর বাড়ির সামনে। ছবি রয়টার্স

জার্মানির এই সন্তান জীবনের দীর্ঘ সময় ছিলেন নির্বাসিত। জার্মানি থেকে ফ্রান্সে, ফ্রান্স থেকে বেলজিয়াম, বেলজিয়াম থেকে ইংল্যান্ড এবং সেখানেই মৃত্যু। ইউরোপের দেশে দেশে ঘুরেছেন, লিখেছেন, শ্রমিকসভায় বক্তৃতা করেছেন। মৃত্যুতেও ফেরা হয়নি স্বদেশে। তাঁর সমাধি হয় লন্ডনে। তাঁর জন্মদিন উদ্‌যাপিত হলো বিশ্বজুড়েই। কিন্তু জন্মের ২০০ বছর পর কীভাবে তাঁর স্বদেশ স্মরণ করছে তাঁকে?

১৮১৮ সালের ৫ মে জার্মানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মোসেল নদীর তীরে টিয়ার্স শহরে জন্ম হয়েছিল কার্ল মার্ক্সের। এবার সেই রাজ্য, স্থানীয় প্রশাসন ও টিয়ার্স শহরের নাগরিকেরা জাঁকজমকের সঙ্গে উদ্‌যাপন করছেন তাঁর ২০০তম জন্মজয়ন্তী। কার্ল মার্ক্স একাধারে দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক তত্ত্ববিদ, সমাজবিজ্ঞানী, বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক ও সাংবাদিক। তাঁর স্বদেশ জার্মানি ও বিশ্বজুড়ে তাঁকে নিয়ে নানা রকম বিতর্ক রইলেও তিনি এখনো রয়েছেন সমাজ, রাজনীতি, অর্থ-বিজ্ঞানের একজন প্রবল প্রতাপশালী চিন্তক হিসেবে। জীবদ্দশায় কার্ল মার্ক্স নিজ দেশে ততটা থাকতে পারেননি নানা নিষেধাজ্ঞা, বহিষ্কার আদেশ আর আইন-কানুনের বেড়াজালের জন্য। শেষ পর্যন্ত থিতু হয়েছিলেন লন্ডনে, আর সেখানেই মৃত্যুবরণ করেছেন ১৮৮৩ সালের ১৪ মার্চ।

কিন্তু জগৎজয়ী এই কার্ল মার্ক্সকে ভুলে যাননি তাঁর ঘরের মানুষেরা। ৫ মে তাঁর জন্মভূমি ট্রিয়ার্স শহর ও রাজ্য প্রশাসন আয়াজন করছে জাঁকজমকপূর্ণ দ্বিশতজন্মজয়ন্তী। বার্লিন, ব্রাসেলস আর চীন থেকে উপস্থিত হয়েছিলেন রাজনীতিকেরা। ট্রিয়ার্স শহরের মেয়র ভল্ফাম লাইবে বলেছেন, ‘আমাদের শহরের সন্তানের এই ২০০তম জন্মজয়ন্তীতে এতটা সাড়া পাওয়া যাবে, তা কল্পনাতীত।’ মূল অনুষ্ঠানে কার্ল মার্ক্সের প্রপৌত্র ফ্রিডেরিকে এবং আন লঙ্গেয়েট মার্ক্সসহ উপস্থিত হয়েছিলেন ৫০০ নিমন্ত্রিত অতিথি। অনুষ্ঠানে ২০০ বছর আগের কার্ল মার্ক্সের জন্মসনদ থেকে পাঠ করেন জার্মানির বিখ্যাত টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব গুন্টার ইয়ায়ুক। মূল অনুষ্ঠানের পর জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দল ও বাম দলের পক্ষ থেকে আলোচনা ও সংগীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। জার্মানির জেডডিএফ টেলিভিশন ২০০তম জন্মজয়ন্তীতে কার্ল মার্ক্সকে নিয়ে ‘কার্ল মার্ক্স দ্য জার্মান প্রফেট’ নামের ডকুমেন্টারি সিরিজ তৈরি করেছে।

২০০তম জন্মজয়ন্তীর প্রাক্কালে জার্মানির রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্ক ভাল্টার স্টাইনমায়ার কার্ল মার্ক্সকে জার্মানির মহান চিন্তাবিদ হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, ‘তাঁর রচনা এবং তাঁর শব্দাবলির অসাধারণ প্রভাব ছিল। মার্ক্স ছিলেন সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক এবং এই সবকিছুই ছিল মানবিকতার জন্য। আমরা জার্মানরা কার্ল মার্ক্সকে নিয়ে অতিরঞ্জিত করব না আবার আমাদের ইতিহাস থেকে বিতাড়িত করতে পারি না এবং তাঁকে নিয়ে আমাদের ভয় পাওয়ারও কোনো কারণ নেই।’ জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জঁ ক্লদ ইয়ুঙ্কার সবাইকে সতর্ক করে বলেছেন, কমিউনিজমের নামে তাঁর অনুসারীদের অনাচারের জন্য কোনোভাবেই কার্ল মার্ক্সকে দায়বদ্ধ করা যাবে না।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিংপিং গত শুক্রবার বলেছেন, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি চিরকাল মার্কসবাদকে রক্ষা ও চর্চা করে যাবে। ভিয়েতনামের নেতা ট্রান দাই কুয়াংও মার্কসের জন্মদিনে শুভেচ্ছাবাণী প্রকাশ করেছেন।

মার্ক্সের দ্বিশতজন্মজয়ন্তীকে কেন্দ্র করে জার্মানির রাইনল্যান্ড ফ্যালৎস রাজ্যের টিয়ার্স শহরের জনগণ তাঁদের শহরের জগদ্বিখ্যাত ছেলেকে স্মরণ করতে আয়োজন করেছেন বছরব্যাপী মার্ক্স উৎসবের। বছর জুড়ে ৬০০ টি অনুষ্ঠান হবে তাঁর স্মরণে। তাঁর বাড়িটাকে পরিণত করা হয়েছিল কার্ল মার্ক্স জাদুঘরে। সেখানে ১৮১৮ থেকে ১৮৮৩ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবনবৃত্তান্ত এবং সারা ইউরোপ থেকে সংগৃহীত মার্ক্সবিষয়ক ৪০০ দলিল-দস্তাবেজের প্রদর্শনী চলছে। চলবে এই বছর অক্টোবর মাস অবধি। বিশেষ প্রদর্শনীটি ৪ মে সন্ধ্যায় উদ্বোধন করেছেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জঁ ক্লদ ইয়ুঙ্কার।

অন্যদিকে প্রতিপক্ষও বসে ছিল না। এই জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে ট্রিয়ার্স শহরে জার্মানির কট্টর রক্ষণশীল দল অলটারনেটিভ ফর জার্মানি মৌন মিছিল এবং মার্ক্সবাদী নাম ভাঙিয়ে কমিউনিস্ট স্বৈরাচার দ্বারা নির্যাতিত নামের একটি সংগঠন মানববন্ধন করেছেন। তাঁরা সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানিতে কমিউনিস্ট আমলের অন্যায়–অত্যাচারের কথা স্মরণ করে মার্কসের নিন্দা করেন। আর এর নেতৃত্ব দিচ্ছে দক্ষিণপন্থি দল এএফডি।

কার্ল মার্ক্স জন্মের পর ট্রিয়ার্স শহরে ১৭টি বছর কাটিয়েছিলেন। তারপর আর সেভাবে ঘরে ফেরা হয়নি। তবে নিজ শহরে কার্ল মার্ক্সের এই সাড়ম্বর ২০০তম জন্মজয়ন্তী যেন তাঁকে নিজ ভূমে আবারও ফিরিয়ে আনছে। বার্লিন দেয়ালের পতনের পর ঐক্যবদ্ধ জার্মানি সমাজতন্ত্র ফেলে পুঁজিবাদকে পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে। ইতিমধ্যে সেই পুঁজিবাদের কুফল যত জার্মান সমাজে স্পষ্ট হচ্ছে, ততই কার্ল মার্কসের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। পাশাপাশি ডান ও বামের বিভক্তিও প্রকট হচ্ছে জার্মানিতে।

সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর হ্যানোভার, জার্মানি প্রতিনিধি।
[email protected]