এখন নির্বাচনটি আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ

খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক  এবং বিএনপির প্রার্থী  নজরুল ইসলাম মঞ্জু
খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক এবং বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু

সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে চারটি সিটি নির্বাচনের ফলাফলই আওয়ামী লীগের জন্য অগ্নিপরীক্ষার বিষয় ছিল। এখন শেষ মুহূর্তে সাভারের একজন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, যিনি একজন ইউপি চেয়ারম্যান, তাঁরই দায়ের করা রিটে আকস্মিক গাজীপুরের নির্বাচন স্থগিত হলো। তবে রিটকারীর সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ যা হলো, তাতে আমরা বিভ্রান্ত। কারণ, তাঁর দাবি, গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে তাঁর কিছুই বলার নেই। নির্বাচন স্থগিত হোক, সেটা চাননি তিনি। তবে চারটি নির্বাচনই যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও ভালো নির্বাচন হয়, তাহলে তা জাতীয় নির্বাচনের জন্য একটি মোক্ষম সমীক্ষা হিসেবে গণ্য হতে পারে। ভোটাররা প্রতীকনির্ভর হবেন। আর তাই যে প্রতীক সিটিতে জয় পাবে, সেই একই প্রতীক সংসদেও জিততে পারে। এর মধ্যে খুলনা আমাদের কাছে বেশি আগ্রহ সৃষ্টি করেছে, তার কারণ, মুখ্য দুই প্রার্থীই মোটামুটি পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির। দুই দলই খুব হিসাব করে যোগ্যতম প্রার্থী দিয়েছে। উভয় দলের কেন্দ্রীয় নেতারা সক্রিয়ভাবে প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। এবারের ইফতার ও ঈদ রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়াবে খুলনা।

গাজীপুরে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে নিয়ে একটা কঠিন অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন ছিল। নির্বাচনী প্রচারণায় তার ছাপ স্পষ্ট ছিল। নির্বাচন স্থগিত হওয়ায় আপাতত সেটা আর বিচার্য থাকছে না। কিন্তু খুলনায় উভয় প্রার্থীর পেছনেই উভয় দলের নেতা-কর্মীরা সর্বাত্মকভাবে তৎপর। সহকর্মী শেখ আল এহসান ও উত্তম মণ্ডল জানালেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীর নিজেদের গরজ ছিল না নির্বাচন করার। আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক প্রথম আলোকে বলেছিলেন, তিনি একজন সংসদ সদস্য। তিনি সিটি নির্বাচন করতে চান না। নতুনদের সুযোগ করে দিতে চান। তবে শেষ পর্যন্ত দল তাঁকেই খুলনার মেয়র পদে প্রার্থী হিসেবে যোগ্য মনে করে মনোনয়ন দেয়। বিএনপির নজরুল ইসলামও নির্বাচন করতে আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর পছন্দের প্রার্থী ছিলেন বর্তমান মেয়র মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। তবে আওয়ামী লীগের শক্ত প্রার্থীর সঙ্গে লড়তে বিএনপি মঞ্জুকেই উপযুক্ত মনে করেছে।

নির্বাচনব্যবস্থা সম্পর্কে আমরা যখন ক্রমশ হতাশ, তখন এই সিটি নির্বাচন একটি আলোকবর্তিকা হতে পারে। উভয় দলের নেতাই প্রথম দিকে বাগ্যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তবে তাঁদের সেই সব বক্তব্য ছিল রাজনৈতিক। এ ছাড়া এ পর্যন্ত পরস্পরের প্রতি সৌজন্যমূলক বক্তব্যই দিয়ে আসছেন। বোধগম্য কারণেই এর ফলাফল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেবে। এটা স্বস্তির যে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী প্রায় পাঁচ ঘণ্টা নিজেকে নির্বাচনী প্রচারণা থেকে দূরে সরিয়ে রাখলেও পুনরায় ফিরে এসেছেন। কিন্তু যা অস্বস্তির সেটা হলো, ভোটারদের মধ্যে সাধারণভাবে একটা ভয়ভীতির সঞ্চার ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয়। আর প্রচারণা বর্জন মনে কেমন ভয় ধরিয়ে দেয় যে এটা আবার নির্বাচন বর্জনে রূপ না নেয়। পরিস্থিতি যেমনই হোক, নির্বাচন বর্জন বা মাঠ ছেড়ে দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়। বিএনপি অবশ্য বলছে, খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। যা-ই হোক না কেন, মাঠ তাঁরা ছাড়বেন না। অবশ্য সার্বিকভাবে বিচ্ছিন্ন দু-একটা সংঘাতের ঘটনা ছাড়া বড় অঘটন সেখানে নেই।

তদুপরি কারও কারও মতে, খুলনায় ভোটাররা নির্বিঘ্নে তাঁদের পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নিতে পারবেন কি না, সেটা একটা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, তাঁরা লক্ষ করছেন, নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থী ও সমর্থকদের মধ্যে ততই উত্তাপ বাড়ছে। তবে দুজন পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির নেতার অংশগ্রহণে যে নির্বাচন, সেখানে যদি পুলিশ এতটা বাড়াবাড়ি করে, তাহলে ভিন্ন ক্ষেত্রে কী হবে? দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার রুখবে কে? ইসির দেখানো উচিত, তারা নিধিরাম সরদার নয়।

খুলনার নির্বাচনে যাতে সর্বোচ্চ ভোটার অংশ নেন, নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্নগুলো যদি ফিকে হয়ে যায়, তাহলে সাধারণ মানুষ একটা নিরাপত্তাপূর্ণ পরিবেশে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবেন। সুতরাং, নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই বাড়তি পদক্ষেপ নিতে হবে। কাজকর্মে বোঝাতে হবে ভোটারদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরির সব রকম চেষ্টা তারা করছে। বিএনপির প্রার্থী সেনা মোতায়েনের দাবি করেছিলেন, কিন্তু আওয়ামী লীগ তা সমর্থন করেনি। আমরা বিশ্বাস করি, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের চাওয়া বা না-চাওয়া বিবেচনায় নয়, ইসি সেনা মোতায়েন না করার সিদ্ধান্ত নিজস্ব বিচার-বিশ্লেষণ থেকেই নিয়েছে এবং সেনাবাহিনী ছাড়াই তারা ভোটারদের জন্য একটি উৎসবমুখর পরিবেশ নিশ্চিত করতে সক্ষমতার পরিচয় দেবে।

আমরা স্মরণ করতে পারি, ২০১৩ সালে খুলনাসহ চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একই দিনে ভোট গ্রহণ এবং চারটিতেই আওয়ামী লীগ যে পরিবেশে পরাজয় দেখেছিল, তা থেকে ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনী বছরটি নানা দিক দিয়ে ব্যতিক্রম। বিএনপির নেতা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের পাঁচ বছর মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। নাশকতার মামলায় তাঁর কারাগারে গমন, মেয়র পদে তাঁকে বরখাস্ত করা এবং উচ্চ আদালতের আদেশে পুনরায় মেয়র পদে পুনর্বহাল হওয়া এবং বড় ধরনের কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ না পাওয়ার অভিযোগের মধ্য দিয়ে তাঁর ডামাডোলপূর্ণ পাঁচ বছর কেটেছে।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক, যিনি এক-এগারোতে ২০০৮ সালে জয়ী হয়ে এলাকায় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছিলেন, কিন্তু গত মেয়র নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন, তিনি এবার প্রার্থী হতে গিয়ে বাগেরহাটের একটি আসনের সংসদ সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। খুলনা আওয়ামী লীগে তিনি ঐকমত্যের প্রার্থী, কিন্তু ঐতিহ্যগতভাবে সিটি করপোরেশনের ভোটাররা আওয়ামী লীগের প্রতি ঠিক ততটা অনুরাগী, তা ভোটের ইতিহাস বলে না। খুলনা সিটিতে দুটি সংসদীয় আসন। খালিশপুর, দৌলতপুর ও খানজাহান আলীর কিছু অংশ নিয়ে গঠিত খুলনা-৩ আসনে ১৯৯১ ও ২০০১ সালে বিএনপি জিতেছে। আর খুলনা সদর ও সোনাডাঙ্গা নিয়ে গঠিত খুলনা-২ আসনে ১৯৯০ সালের পর ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন ছাড়া আওয়ামী লীগ কখনো জেতেনি। মেয়র নির্বাচনে এ দুটি থানার ভোটারসংখ্যা খুলনা-৩ আসনের চেয়ে বেশি। আর এক-এগারোতে ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী ও মহানগর সভাপতি নজরুল ইসলাম খুলনা-২ আসনে জয়লাভ করেছিলেন।

খুলনায় বিএনপির প্রার্থীর প্রচারণায় যুক্ত থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ, পুলিশ তাঁদেরও গ্রেপ্তার করেছে-এই অভিযোগ তুলেই বিএনপি প্রচারণা স্থগিত করেছিল। আওয়ামী লীগ বলেছে, যাঁরা সন্ত্রাসী, মামলার আসামি, পুলিশ তাঁদের ‘আইনের আপন গতিতে’ গ্রেপ্তার করলে তাদের কী করার আছে? এই যুক্তি নাকচ করা যাবে না, আবার এটাও রূঢ় বাস্তবতা যে মামলাগুলো সম্প্রতি দায়ের করা হয়নি, এসব তথাকথিত রাজনৈতিক মামলায় অভিযুক্ত হয়ে এই আসামিরা এত দিন দিব্যি ঘোরাফেরা করে চলছিলেন। কিন্তু এখন নির্বাচনী প্রচারণা যখন তুঙ্গে, তখন আকস্মিকভাবে শুধু তাঁদের বেলায় ‘আইনের আপন গতি’ প্রত্যক্ষ করাও প্রশ্নের উদ্রেক করে। গত বুধবার খুলনায় এক রাতেই পুলিশ বিএনপির ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে এবং হোটেল ও বাড়িতে হানা দিয়ে আরও অনেককে ঘরছাড়া করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। উপরন্তু রূপসা, তেরখাদা ও দিঘলিয়ার মতো আশপাশের থানাগুলোতেও পুলিশ বিএনপির কর্মীদের গ্রেপ্তার করছে।

বিএনপি সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে খুলনার পুলিশ কমিশনার ও গাজীপুরের এসপিকে নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল। সিইসি অভিযোগ খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছিলেন। আদালত নির্বাচন স্থগিত করায় তাঁদের কাজ আপাতত কিছুটা লাঘব হয়েছে। আমরা আশা করব, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি এবং ভোটারদের মধ্যে ভীতি দূর করতে নির্বাচন কমিশন ও সরকার উভয়ে দায়িত্বশীল ও বিশ্বাসযোগ্য ভূমিকা রাখবে। খুলনাবাসীর উৎকণ্ঠা কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে একটি মোক্ষম কথা বললেন একজন স্থানীয় পর্যবেক্ষক। তাঁর কথায়, এলাকাটি সবুর খানের। এখনো অনেক মানুষ কমবেশি সেই ভাবধারাতেই ভোট দেন। তবে ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সাল ও এর পরের আওয়ামী লীগ অনেক কঠিন ও আক্রমণাত্মক। তাই অবাধে ভোট দিতে তাঁদের যত ভয়।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]