এক অদ্ভুত সময় পার করছি আমরা

রয়টার্স ফাইল ছবি।
রয়টার্স ফাইল ছবি।

আমরা এখন এক অন্য রকম সময়ে বাস করছি। এই দেশে এখন শতাধিক টিভি চ্যানেল। সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন ও নিউজ ওয়েবসাইটের সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি। এরপরও ‘নাই হয়ে যাওয়া’ কিংবা নির্যাতনের শিকার হওয়া ছাড়াই আমরা স্বাধীনভাবে সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চক্রান্তের বিষয়ে মন্তব্য করতে পারি না। আদালত অবমাননার দায়ে জেল খাটা ছাড়াই স্বাধীনভাবে আমরা বিচারকদের মন্তব্য কিংবা রায় নিয়ে মুখ খুলতে পারি না।

আমরা এখন এক অন্য রকম সময়ে বাস করছি। প্রায় এক মাস হতে চলল নতুন সরকার দেশ চালাচ্ছে; কিন্তু এখনো আমরা জানতে পারিনি, অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী কে হবেন; কারা কারা অন্তর্বর্তীকালীন মুখ্যমন্ত্রী হবেন। আমরা এখনো জানি না নির্বাচন নির্ধারিত সময়ে হবে কি না; আর হলেও তা স্বচ্ছ হবে, নাকি কারচুপির নির্বাচন হবে, তা আমরা বুঝতে পারছি না।

আমরা এখন এক অন্য রকম সময়ে বাস করছি। সর্বত্রই এখন ‘অদৃশ্য হাত’ ভিন্নমতের কণ্ঠ চেপে ধরছে। চার বছরেরও বেশি সময় ধরে বেলুচিস্তানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত পিএমএলএন সরকার প্রভাব-প্রতিপত্তির সঙ্গে টিকে ছিল। হঠাৎ করে একদিন জানা গেল, ধোঁয়ার মতো সেই সরকার বাতাসে মিলিয়ে গেছে এবং সামরিক প্রতিষ্ঠানের ‘প্রতিনিধি’ হিসেবে বিচিত্র চরিত্রের ভাঁড়েরা তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এমকিউএম সক্রিয়ভাবে দল চালিয়েছে। হঠাৎ করেই তারা তিন ভাগ হয়ে গেল। প্রতিটি ভাগই সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। দুই দশকের বেশি সময় ধরে নওয়াজ শরিফ পিএমএলএনের সভাপতি এবং তিন তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। হঠাৎ জানা গেল, তিনি আর এসবের মধ্যে থাকতে পারবেন না। এভাবেই বিচিত্র ঘটনা ঘটছে।

আমরা এখন অদ্ভুত সময় পার করছি। পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে ভুট্টোদের পিপলস পার্টি এই দেশের প্রধান উদারপন্থী ও সামরিক প্রতিষ্ঠানবিরোধী দল হিসেবে চালু ছিল। এখন জারদারির অধীনে এই দল সামরিক প্রতিষ্ঠানের তল্পিবাহক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাত দশকের বেশি সময় ধরে মুসলিম লিগ সামরিক প্রতিষ্ঠানের সমর্থক দল হিসেবে পরিচিত। নওয়াজ শরিফের অধীনস্থ এই দলই এখন সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তিবিরোধী দল হয়ে উঠেছে। বহু দিন ধরে নওয়াজ শরিফ সামরিক শক্তির অনুগ্রহ ভোগ করেছেন। এখন তিনিই তাদের প্রধান শিকারে পরিণত হয়েছেন।

আমরা এক অন্য রকম সময় পার করছি। কিছু পার্টি ও রাজনীতিককে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া এবং কিছু পার্টি ও রাজনীতিককে তুলে ধরার জন্য বিশাল রাজনৈতিক কূটকৌশল খাটানো হচ্ছে। অতীতে এসব হয়েছে সামরিক আইন এবং পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের ছত্রচ্ছায়ায়। কিন্তু এবার একটু অন্য কায়দায় সামরিক আইন খাটানো হচ্ছে। সামরিক শক্তি এবার সরাসরি সামনে আসছে না। বিচারকদের মুখোশের আড়ালে তারা রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে।

আমরা একেবারেই অন্য রকম একটি সময় পার করছি। পিপিপির উদারপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ সমর্থকেরা গভীর হতাশায় আছেন। অনেকেই চাপা ক্ষোভ নিয়ে চুপ মেরে গেছেন। অনেকে মন্দের ভালো হিসেবে নওয়াজ শরিফের পক্ষে চলে গেছেন, কারণ তিনিই এখন দেশটির একমাত্র প্রতিষ্ঠানবিরোধী নেতা।

আমরা এক ভিন্ন রকম সময় পার করছি। পাকিস্তানের প্রথম দুই দশকে বেসামরিক-সামরিক আমলাদের জন্য এবং অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের অভাবের কারণে বারবার হোঁচট খেয়েছি। এ দুই দশক ধরে রাজনৈতিক কারচুপি করার ফল হিসেবে তৃতীয় দশকে এসে আমরা দেশের অর্ধেকটা হারিয়ে ফেললাম। তবে এ সময় সাংবিধানিক কাঠামো দাঁড় করাতে পারলাম। কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা সেই সাংবিধানিক আইন লঙ্ঘন করলাম এবং তার পরিণতিতে চতুর্থ দশকে এসে সামরিক আইনের ঘানি টানতে হলো।

পঞ্চম দশকে এসে আমরা একেকটি কারচুপির নির্বাচন এবং সরকারকে আরেকটি কারচুপির নির্বাচন ও অনৈতিক সরকারের দিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকলাম। ষষ্ঠ দশকে সামরিক আইন জারি না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের অস্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে যেতে থাকলাম।

সপ্তম দশকে এসে আমরা গণতন্ত্রের সনদের প্রতি সবাই শ্রদ্ধাশীল থাকব বলে ঘোষণা করে শেষ পর্যন্ত খেলার নিয়ম ভাঙতে সামরিক শক্তির সঙ্গে হাত মেলালাম। এখন দুই-দুজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে ‘ন্যায়বিচারের’ বেদিতে বলি দেওয়ার পর আমরা নতুন দশকে নতুন করে রাজনৈতিক কারসাজির খেলা শুরু করেছি।

পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এর আগে কখনো এতটা অনৈক্য দেখা যায়নি। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বহির্বিশ্বে এখন পাকিস্তানের শত্রু বেশি। আর্থিক, জনসংখ্যাতাত্ত্বিক এবং পরিবেশগতভাবে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন পাকিস্তান বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। রাজনীতি নিয়ে এখন যত বেশি কারসাজি করা হবে, অবস্থা ততটাই খারাপ হবে।

আমরা একটা অদ্ভুত সময়, অন্য রকম সময় পার করছি।

দ্য ফ্রাইডে টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
নাজাম শেঠি :পাকিস্তানের সাংবাদিক ও কলামিস্ট