শুধু সহমর্মিতা নয়, টাকাও প্রয়োজন

জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা পরিদর্শনে আসার পর তাঁদের সামনে প্ল্যাকার্ড তুলে ধরেন কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা
জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা পরিদর্শনে আসার পর তাঁদের সামনে প্ল্যাকার্ড তুলে ধরেন কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা

গেল বছরের আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের লোকজনের বাংলাদেশে প্রবেশের ঢল নামে। তারা মাতৃভূমি ও সহায়সম্পদ ফেলে আমাদের দেশে আশ্রয় নেয়। তাদের অনেকেরই জমিজমা, বাড়িঘর, গবাদিপশু, পুকুর, গাছপালা, ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। এ দফায় এসেছে ৭ লাখের বেশি। আগে আসাও ছিল ৩ লাখের ওপরে। সর্বশেষ হিসাবে সব মিলিয়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় ঠাঁই নিয়েছে।

এই দুটো উপজেলার স্থানীয় অধিবাসীর সংখ্যা লাখ পাঁচেক। এর দ্বিগুণ ভিনদেশির সেখানে সাময়িক বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তা করতে গিয়ে বিপন্ন হয়েছে পাহাড়, জঙ্গল। তারা এসেছে সে দেশের সরকারি বাহিনী ও স্থানীয় একটি সম্প্রদায়ের অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে। সেই নির্যাতনের আকৃতি ও প্রকৃতি বারবার আলোচিত হয়েছে পত্রপত্রিকায়। জনবহুল বাংলাদেশ এ বিপন্ন আশ্রয়প্রার্থীদের মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে। আশা করা হয়েছিল খুব দ্রুতই তাদের ফেরত পাঠানো যাবে। চীন, রাশিয়া ও অংশত ভারত ব্যতীত মিয়ানমার সরকারের এ ভূমিকায় বিশ্বসম্প্রদায় ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত। জাতিসংঘ নানাবিধ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু মিয়ানমার এ বিষয়ে তাদের অবস্থান থেকে তেমন সরে এসেছে-এমন কিছু লক্ষণীয় হয় না।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিসহ সব সদস্যদেশের প্রতিনিধি বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর করেছেন। তবে বাংলাদেশে অবস্থানকালে নিরাপত্তা পরিষদের রুশ প্রতিনিধি বলেছেন, তাঁদের কাছে জাদুর চেরাগ নেই। কথাটি অসত্য নয়। তবে সে রাষ্ট্রটির দৃষ্টিভঙ্গিতেও যে তেমন পরিবর্তন হয়নি, এমনটা অনুমান করা চলে। নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন দেশ রাশিয়া ও চীনের জন্যই মিয়ানমারের এ জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ এখন পর্যন্ত তেমন ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়নি। তবে তারা অবিরাম প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশগুলো শুরু থেকে এই মানবিক বিপর্যয়ে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল। অনুরূপ সহানুভূতিশীল হয়ে এগিয়ে এসেছে তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ মুসলিম-অধ্যুষিত দেশগুলো। বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ বিষয়ে যথেষ্ট সোচ্চার। তাদের এ সহমর্মিতা আমাদের জন্য শক্তি ও প্রেরণার উৎস।

এই সহমর্মিতার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের খাদ্য, বস্ত্র, আবাসন, চিকিৎসা ইত্যাদির জন্য আমাদের সরকার ও জনগণের বিভিন্ন শ্রেণির পাশাপাশি অনেক দেশ সরকারিভাবে সহায়তা দিচ্ছে। কাজ করছে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাগুলো। তবে কার্যক্রমটির সাংগঠনিক কাঠামো দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। আর মূল সহায়ক শক্তি জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন। এগুলোর মধ্যে আছে জাতিসংঘ উদ্বাস্তুবিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর), ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব মাইগ্রেশন (আইওএম), বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ইত্যাদি। জাতিসংঘ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো চলে সদস্যদেশগুলোর চাঁদার টাকায়। এ-জাতীয় মানবিক বিপর্যয়ে তারা বাজেট তৈরি করে সদস্যদেশগুলোর সহায়তা চায়। আশানুরূপ না হলেও মোটামুটি পেয়ে আসছিল। তবে ইদানীং মনে হয় ভাটার টান পড়েছে। খাদ্যসহায়তার ব্যবস্থা করছে ডব্লিউএফপি।

স্থানীয় একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রতিবেদন অনুসারে গেল মার্চ থেকে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত খাদ্যের জন্য ২৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন হলেও এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে ৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ চাহিদার ১৮ শতাংশ। বাংলাদেশে সংস্থাটির কান্ট্রি ডিরেক্টর কোনো রকম রাখঢাক ছাড়াই সরাসরি বলেছেন, ‘চাহিদা ও প্রাপ্তির মাঝে রয়েছে বিরাট ফারাক এবং এটা একটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা।’ তাঁর মতে, বিভিন্ন দেশে শরণার্থী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দাতাদেশগুলোর অর্থায়নে সীমাবদ্ধতা এসেছে। এ সংস্থা গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮৮ মিলিয়ন ডলার চাহিদার বিপরীতে ৭৭ মিলিয়ন ডলার পেয়েছিল। ডব্লিউএফপির চলতি সময়সীমার এ বাজেট জাতিসংঘের অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের কার্যক্রমের একটি অংশ মাত্র। মোট কার্যক্রমটি ৯৫১ মিলিয়ন ডলারের। এটা জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান শিরোনামে প্রণীত। এতে ১০ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ২ লাখ স্থানীয় নিম্ন আয়ের লোকের চাহিদাও ধরা হয়েছে। এটা একটি সংগত পরিকল্পনা। স্থানীয় অধিবাসীদের জীবন-জীবিকা রোহিঙ্গা আগমনে প্রচণ্ড চাপের মুখে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে যোগাযোগ অবকাঠামো। স্থানীয় শ্রমবাজারে রোহিঙ্গাদের অনাকাঙ্ক্ষিত উপস্থিতি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই এ পরিকল্পনায় স্থানীয় অধিবাসীদের অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত যৌক্তিক। এখন অর্থায়নের পরিমাণ যা দেখা যাচ্ছে, তাতে রোহিঙ্গাদেরই চলবে না। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার এ বৈরী পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করবে?

একই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ডব্লিউএফপির কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেছেন, ডিসেম্বরের পর এ কার্যক্রম চালানোর মতো অর্থ পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তিনি রোহিঙ্গাদের আমাদের সরকারি ও বেসরকারি খাতের আয়বর্ধক কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর মতে, অনেক দাতাদেশ জানতে পায় রোহিঙ্গাদের দিয়ে আয়বর্ধক কী কাজ করানো হচ্ছে। ডব্লিউএফপির কান্ট্রি ডিরেক্টর বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চয় অবগত আছেন। এ দেশে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে কোনো বিশেষায়িত জ্ঞানসম্পন্ন লোক আছে বলে জানা যায় না। তারা মূলত কৃষক ও শ্রমজীবী। আমাদের এ শ্রেণির শ্রমশক্তিকেই আমরা যথাযথভাবে কাজ দিতে পারছি না। তাহলে এই জনবহুল দেশটিতে ১১ লাখ অতিরিক্ত লোকের কর্মসংস্থানের প্রস্তাব কী করে আসতে পারে, তা বোধগম্য নয়।

বিশ্বসমাজ রোহিঙ্গাদের প্রতি সহমর্মিতা জানাচ্ছে। তাদের দেখতে, তাদের কথা শুনতে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা আসছেন। তাঁরা মিয়ানমারের ভূমিকার সমালোচনাও করছেন। প্রশংসা করছেন আমাদের। পাশাপাশি বলছেন, রোহিঙ্গাদের এখন মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ নেই। কথাটি হয়তোবা সত্যি। সে পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বিশ্বসমাজের বড় রকমের দায় আছে, এটাও তো সত্যি। যারা ভেটো দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে মিয়ানমারের এ অমানবিক কার্যক্রম সমর্থন করল, তারা গোটা বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করে, এমন তো নয়। জনাধিক্যের জন্য রোহিঙ্গাদের দীর্ঘকাল স্থান দিতে বাংলাদেশের অক্ষমতা জাতিসংঘকে মেনে নিতে হবে। আর ‘ক্ষমতাধর’ মিয়ানমারকে যদি তারা বাগে আনতে না পারে, তবে তাদের কার্যকারিতাও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

আমরা কিন্তু ডব্লিউএফপির কান্ট্রি ডিরেক্টরের বক্তব্যে শঙ্কিত ও বিচলিত। অবশ্য তিনি এ সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা। তহবিলের সংস্থান হলে খুশি হয়ে কাজ করবেন। তবে তহবিল সংস্থান যাতে হয় সে ব্যাপারে জোরালো প্রয়াস তো নিতে হবে তাঁদেরই। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত দিলে অমানবিক বলে মন্তব্য করা হয়। হয়েছেও ২০১২-এর দিকে। আর এবার ঢলের মতো রোহিঙ্গারা আসতে চাইলে আমরাও মানবিক প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সীমান্ত খুলে দিলাম। সমস্যাটি মিয়ানমারের তৈরি করা। সমাধান করতে হবে তাদেরই। বিশ্বসমাজ দৃঢ় পদক্ষেপ নিলে মিয়ানমারকে দ্রুতই তা করতে হবে। রোহিঙ্গারা নিজ দেশে মর্যাদার সঙ্গে ফেরত গেলে তাদের জন্য কিংবা স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়ের জন্য কেউ সাহায্য-সহযোগিতা চাইবে না। এ বিষয়ে আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। চীন, রাশিয়া ও ভারতে আমাদের এ বিষয়ে জোর দিয়ে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি পাঠানোর আবশ্যকতা রয়েছে।

মোদ্দা কথা, এ রোহিঙ্গা সমস্যায় আমরা বিশ্বসমাজকে মোটামুটি পাশে পেয়েছি। নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থনও তারা দিয়েছে। এখনো দিচ্ছে। তবে মিয়ানমারের বৈরী মনোভাব বিপরীতমুখী করতে জাতিসংঘ তেমন সফল হয়েছে-এমনটা বলা যাবে না। সে ক্ষেত্রে এ দেশে রোহিঙ্গাদের অবস্থান দীর্ঘায়িত হলে বৈষয়িক সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। এত স্বল্প সময়ে অধৈর্য হয়ে আমাদের সমস্যাটি বিবেচনায় না নিয়ে এ দেশের শ্রমবাজারে রোহিঙ্গাদের নিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া অসংগত। বিষয়টি আমাদের জন্য পরিহাসের মতোই শোনায়। আশা করব, জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের জন্য সহানুভূতির পাশাপাশি আমাদের সামর্থ্যও বিবেচনায় রাখবে।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]