নির্বাচন হবে, তবে...

খুলনা সিটি করপোরেশন ভবন । ফাইল ছবি
খুলনা সিটি করপোরেশন ভবন । ফাইল ছবি

যশোর থেকে সড়কপথে কিংবা রূপসা সেতু পার হয়ে খুলনা গেলে চিনতে অসুবিধা হবে না শহরের সীমানাটা কোথায়। প্রবেশমুখেই সাদাকালো অসংখ্য পোস্টার টানানো, সারা শহরে একই চিত্র। প্রার্থীরা এখন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছেন। বাড়িতে বাড়িতে উঠোন বৈঠক করছেন। পথসভায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। তাঁদের চোখে ঘুম নেই। রাত ১১টায় আমরা একজন মেয়র পদপ্রার্থীর বাড়িতে গিয়ে শুনি তিনি সকাল ছয়টায় বের হয়ে যান। ফেরেন রাত সাড়ে ১২ টা-১টায়। দুঃখের বিষয়, জনগণের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের এই সংযোগ ও সৌহার্দ্য ভোটের পর থাকে না। ভোটের আগে ভোটাররা রাজা। আর ভোটের পর তাঁরা আমজনতা।

নির্বাচন সামনে রেখে খুলনা এখন সরগরম। গাজীপুর সিটির ভোট হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর সারা দেশের দৃষ্টি এখন এই শহরের প্রতি। অনেকের মনে প্রশ্ন, শেষ মুহূর্তে কোনো অঘটন ঘটবে না তো? যেহেতু খুলনায় সীমানা নিয়ে কোনো জটিলতা নেই, সেহেতু ভোট হবে। কিন্তু কেমন ভোট হবে, সেই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায় না।

এখন বাংলাদেশে নির্বাচন হওয়াটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। সেটি হোক ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন কিংবা জাতীয় সংসদ।

রোববার আমরা যখন খুলনায় পৌঁছাই, সেদিনই শুনি নির্বাচনী পরিবেশ কিছুটা উত্তপ্ত। ৭ নম্বর ওয়ার্ডে গুলি ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ বলছে, বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর পদপ্রার্থী গুলি করেছেন। বিএনপির নেতাদের দাবি, ওই প্রার্থীকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছিল।  এরপর পুলিশ লাঠিচার্জ করলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়।

পরিস্থিতি এখন থমথমে। হোটেলে, অফিসে, রাস্তায় যাঁকেই ভোট নিয়ে প্রশ্ন করি বলেন, ভালো ভোট হবে। কিন্তু ভালো ভোট হওয়ার পর কী হবে, সেই প্রশ্নের উত্তর তাঁদের জানা নেই। মাঠের উত্তাপ কমলেও ঘরের উত্তাপ যথেষ্টই আছে। সিইসির উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগের পারদ বাড়িয়ে দিয়েছে। বএনপির নেতাদের অভিযোগ, নির্বাচনের ফল আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, ভরাডুবি আঁচ করতে পেরেই বিরোধী দল নির্বাচনকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে।

নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন বাকি। প্রার্থীরা ভীষণ ব্যস্ত। এর মধ্যেই গত সোমবার প্রথম আলোর গোলটেবিল আলোচনায় এসেছিলেন পাঁচ মেয়র পদপ্রার্থী। আওয়ামী লীগের তালুকদার আবদুল খালেক, তিনি আগেও একবার মেয়র ছিলেন। বিএনপির নজরুল ইসলাম মঞ্জু, যিনি ২০০৮ সালে দলের দুঃসময়ে সাংসদ নির্বাচিত হন। আরও ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির মিজানুর রহমান, জাতীয় পার্টির শফিকুর রহমান ও ইসলামী আন্দোলনের মুজাম্মিল হক।

প্রথম আলোর বৈঠকে আরও এসেছিলেন মানবাধিকারকর্মী, নারী নেত্রী ও শিক্ষাবিদ। সবাই বললেন, যেই জিতুক যেন নির্বাচনটি পরাজিত না হয়। মনে যা-ই থাকুক না কেন পাঁচ মেয়র পদপ্রার্থীই সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে বললেন। সবাইকে নিয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। দখল হয়ে যাওয়া ২২ খাল উদ্ধার করে দ্রুত নগরবাসীর সমস্যা দূর করে খুলনাকে তিলোত্তমা নগরী হিসেবে গড়ে তোলার তাগিদ দিলেন। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা পদ্মার এপারের গ্যাসবঞ্চনার কথা বললেন।

তবে সেই সভায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী, যাঁরা এবারই প্রথম ভোটার হয়েছেন, জানালেন, প্রধান দুই দলের প্রার্থীরা যাঁদের নিয়ে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ভোটের প্রচার চালাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যেই অনেকে মাদক ব্যবসা কিংবা সেবনের সঙ্গে জড়িত। বললেন, পাড়ায়-মহল্লায় বখাটেদের হাতে মেয়েরা ইভ টিজিংয়ের শিকার হচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে মেয়র পদপ্রার্থীরা কী পদক্ষেপ নেবেন, সে বিষয়ে তাঁরা প্রশ্ন রাখেন।

খুলনায় এখন ‘বড় নেতাদের’ আনাগোনা চলছে। দুই দলেরই বেশ কিছু কেন্দ্রীয় নেতা আসছেন, যাচ্ছেন। বিধিনিষেধের কারণে সরকারি দলের সাংসদেরা নির্বাচনী এলাকায় ঢুকতে না পারলেও সিটির বাইরে কর্মীদের নিয়ে সলাপরামর্শ করছেন। পুলিশ প্রশাসন ভয়ে আছে, ভোটের সুযোগে সন্ত্রাসী-মাস্তানরা না শহরে ঢুকে পড়ে। নবাগতদের ওপর তাদের কঠোর নজরদারি।

ভোটের পরিবেশের বিষয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের জিজ্ঞেস করলে তাঁরা পরস্পরবিরোধী জবাব দেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ আছে। বিএনপি নেতাদের মতে, আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাঁদের প্রচারে বাধা দিচ্ছেন। পুলিশ বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিএনপির কর্মীদের ভয় দেখাচ্ছে, পাইকারি গ্রেপ্তার করছে। কিন্তু একজন দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে জানান, তাঁরা গ্রেপ্তার করছেন তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের, কে কোন দল করছেন, সেটি তাঁরা দেখছেন না। তারপরও যদি দলীয় পরিচয়ের প্রশ্ন আসে, বিএনপির চেয়ে সরকারি দলের সমর্থকই বেশি গ্রেপ্তার হয়েছেন-আওয়ামী লীগের ১৫ জন, শ্রমিক লীগের ২ জন, ছাত্রলীগের ৫ জন, যুবলীগের ৩ জন। অন্যদিকে বিএনপির ১১ জন এবং জামায়াত-শিবিরের ৭ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।

পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ করে আরও জানা গেল, কোনো মেয়র পদপ্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির মামলা আছে। প্রার্থী না হলে হয়তো গ্রেপ্তারও হতেন। তাঁরা এ দলে ও দলে ভাগ হয়ে থাকেন। সুযোগ বুঝে দলও পরিবর্তন করেন। নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাড়তি সতর্কতায়।

১৫ মের ভোট পর্বটি কেমন হবে? এ বিষয়ে কথা হয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে। কিন্তু তাঁরা মন খুলে কিছু বলছেন না। মধ্যবয়সী ইজিবাইক চালক মিজানুরকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন ভোট হবে? তিনি বললেন, ‘গাজীপুরে যেভাবে ভোট বেলাইনে গেছে, খুলনার ওপর ভরসা রাখতে পারছি না।’

আরেক ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞেস করি, কে জিতবেন নির্বাচনে? তিনি কৌশলে উত্তর এড়িয়ে বললেন, জনগণ যাঁকে চায় তিনিই জিতবেন। তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করি, জনগণ কি ভোট দিতে যেতে পারবে? তিনি নরুত্তর। তাঁর উত্তর পেতে হয়তো আমাদের ১৫ মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

সিটি নির্বাচন নিয়ে খুলনাবাসীর মনে আশার পাশাপাশি আছে ভয়ও।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]