বিচার হবে আন্তর্জাতিক আদালতে?

রুয়ান্ডা গণহত্যা-সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের আইনজীবী ফাতো বিনসুদা
রুয়ান্ডা গণহত্যা-সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের আইনজীবী ফাতো বিনসুদা

ফাতো বিনসুদা এখন আলোচিত হচ্ছেন বাংলাদেশে। তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিত ছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ তদন্তে তাঁর ভূমিকার কারণে। ফাতো রুয়ান্ডা গণহত্যা-সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের আইনজীবী ছিলেন। পরে তিনি রোম স্ট্যাটিউটের মাধ্যমে গঠিত আইসিসি বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর (মামলা পরিচালনকারী) দলের সদস্য হন। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান প্রসিকিউটর পদে তাঁর নিয়োগ অনেকের দৃষ্টি কাড়ে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে তাঁর মতো একজন কালো আফ্রিকান মুসলিম নারীর নিয়োগ বিরলপ্রায় একটি ঘটনা।

ফাতো অবশ্য অল্প সময়ে আলোচিত হয়ে ওঠেন তাঁর কাজের কারণেও। তিনি আইসিসির চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে ইরাকে ব্রিটেনের এবং আফগানিস্তানে আমেরিকার সেনারা এবং সিআইএ যুদ্ধাপরাধ করেছে কি না, তা তদন্তের প্রশ্ন তুলে ধরেন। আল হাসান আবদুল আজিজ নামে মালির একজন ইসলামি জঙ্গির বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে শতাধিক নারীকে বাধ্যতামূলক যৌনকর্মে বাধ্য করার অপরাধে তাকে অভিযুক্ত করেন। ফিলিপাইনের একনায়ক দুতার্তের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা দমনের নামে গণহত্যার অভিযোগ তদন্তের প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দুতার্তে ফাতোকে ফিলিপাইনে প্রবেশ করামাত্র গ্রেপ্তারের হুমকি দিলে বিষয়টি আরও আলোচিত হয়ে ওঠে। ফাতো এখন বাংলাদেশের জন্যও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিপীড়নের তদন্তের উদ্যোগ নিয়ে। তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রি-ট্রায়াল চেম্বারের কাছে আদালতটি এই তদন্ত করার এখতিয়ার রাখেন কি না, তা খতিয়ে দেখতে বলেছেন। চেম্বার এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে তাঁর মতামত ও পর্যবেক্ষণ পাঠাতে বলেছে ১১ জুনের মধ্যে।

ফাতোর এই উদ্যোগ কিছুটা অভিনব এবং ইতিবাচক। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানাভাবে সমালোচিত আইসিসির কার্যকারিতা ও প্রাসঙ্গিকতা বাড়াতে সোচ্চার বিভিন্ন মানবাধিকার গোষ্ঠীর কাছে এমনিতে তাঁর বিভিন্ন উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে। তিনি ব্রিটেনের বিরুদ্ধে তদন্তের কথা বলে সে দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের বিচারের দাবিকে বেগবান করেছেন। মালির অপরাধীর মামলা শুরু করে লৈঙ্গিক অপরাধে আইসিসির এখতিয়ারকে কার্যকর করেছেন। দুতার্তের বিরুদ্ধে তদন্তের সিদ্ধান্তের পর বিশ্বের অত্যাচারী একনায়কদের মনে কিছুটা হলেও ভীতির সঞ্চার করেছেন। এই তদন্ত থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে রোম স্ট্যাটিউট বা রোম চুক্তি থেকে ফিলিপাইন নিজেকে প্রত্যাহার করিয়েছে। কিন্তু প্রত্যাহারের আগেই অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে বলে এই প্রত্যাহার তাকে কোনো আইনগত সুবিধা দেবে না। চতুর দুতার্তে তাই এখন যুক্তি দেখাচ্ছেন যে রোম চুক্তি অনুসমর্থন করা হলেও তা গেজেট নোটিফিকেশন হয়নি বলে ফিলিপাইনের জন্য এটি কার্যকর হবে না।

আর কিছু না হোক দুতার্তের সঙ্গে তাঁর আইনি যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী গুম-খুন, অত্যাচারে সিদ্ধহস্ত শাসক ও বাহিনীপ্রধানগুলোর জন্য সতর্কবার্তা হয়ে থাকবে। কিন্তু ফাতো রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত জাতিগত নিপীড়নের বিচারের ক্ষেত্রে যা করতে চাচ্ছেন তার অভিঘাত হতে পারে আরও বৃহত্তর। কারণ, এতে এমন একটি দেশের অপরাধের তদন্ত করতে চাওয়া হচ্ছে, যে দেশ রোম চুক্তি স্বাক্ষরই করেনি।

২.
মিয়ানমার রোম চুক্তির পক্ষরাষ্ট্র নয়। দেশটি রোম চুক্তি অনুসমর্থন দূরের কথা, এটি স্বাক্ষর পর্যন্ত করেনি। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে আন্তর্জাতিক চুক্তির পক্ষ না হলে কোনো দেশের জন্য চুক্তির বিধান কার্যকরী হবে না। সাধারণভাবে দেখলে তাই এটি মনে হবে যে রোম চুক্তি মিয়ানমারের জন্য কার্যকর নয়। মনে হবে এই চুক্তির বলে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত মিয়ানমারের শাসক বা তার কোনো সেনানায়কের বিচার করতে পারবে না। ফাতো তদন্তের উদ্যোগ নেওয়ার পর মিয়ানমার সরকার জোরেশোরে এ কথাই বলছে।

তবে আন্তর্জাতিক আইন কখনোই এত সরল কোনো বিষয় নয়। যেমন: যদি প্রমাণ করা যায় যে রোম চুক্তির বিধানগুলো ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইনের মতো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, তবে তা চুক্তির বাইরের দেশগুলোর জন্যও প্রযোজ্য বলে দাবি তোলা যাবে। রোম চুক্তির ক্ষেত্রে এমন সম্ভাবনা অবশ্য এখনো তৈরি হয়নি বলে আমার ধারণা। মিয়ানমারের মতো পক্ষ নয়, এমন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রোম চুক্তি প্রয়োগের বিকল্প পথ হচ্ছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত। নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়া ও চীনের ভেটোর কারণে এই সম্ভাবনাও অদূর ভবিষ্যতে নেই তা নিশ্চিত করে বলা যায়।

প্রশ্ন হলো, তাহলে ফাতো কিসের ভিত্তিতে মিয়ানমারের ঘটনার তদন্ত চাচ্ছেন? তিনি এটি চাচ্ছেন, কারণ মনে করেন মিয়ানমার রোম চুক্তির পক্ষরাষ্ট্র না হলেও তার ক্ষেত্রে তদন্ত করা যেতে পারে। তাঁর যুক্তি, রোহিঙ্গা বিতাড়নের অপরাধটি আংশিকভাবে সংঘটিত হয়েছে এমন একটি দেশে (বাংলাদেশ), যে দেশটি রোম চুক্তির পক্ষরাষ্ট্র, তাই এর তদন্ত করা যেতে পারে।

যেকোনো দেশের অভ্যন্তরীণ অপরাধ আইন (যেমন আমাদের দেশের পেনাল কোড/ফৌজদারি কার্যবিধি) অনুসারে একটি অপরাধ একাধিক জেলায় (যেমন ঢাকা থেকে কাউকে অপহরণ করে যশোর নিয়ে গেলে) সংঘটিত হলে, যেকোনো জেলায় অপরাধীর বিচার করা যায়। টেরিটোরিয়াল জুরিসডিকশনের এই তত্ত্ব অনুসারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিপীড়ন ও মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে তাদের মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত বিতাড়ন অবধি। ফাতোর যুক্তি সম্ভবত তাই এটি যে, এই অপরাধ তদন্তের এখতিয়ার আইসিসির রয়েছে।

অপরাধ তদন্ত ও বিচার তাই বলে এক জিনিস নয়। আইসিসি যদি ফাতোর পক্ষে অনুমোদনও দেয়, অভিযুক্তরা রোম চুক্তির পক্ষ নয়-এমন একটি দেশে (মিয়ানমার) অবস্থান করছে বলে তাদের গ্রেপ্তার বা বিচার সম্ভব হবে না। তবে মিয়ানমারের অপরাধীরা চুক্তি স্বাক্ষরকারী অন্য কোনো দেশে গিয়ে (যেমন ব্রিটেন) গ্রেপ্তার হলে, তখন বিচারের একটি সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।

৩.
বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকটের ভুক্তভোগী রাষ্ট্র। আইসিসি প্রি-ট্রায়াল চেম্বার প্রাসঙ্গিকভাবেই এ বিষয়ে বাংলাদেশের মতামত চেয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত, যুক্তি ও তথ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্তের পক্ষে মতামত দেওয়া। তাহলে চেম্বারের পক্ষে ফাতোকে (বা আইসিসি প্রসিকিউশন টিম) এটি তদন্ত করার অনুমোদন দেওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। এই তদন্তে মিয়ানমার কোনো সহযোগিতা না করলেও এটি শুরু হলে তা নিয়ে বিশ্বসমাজের বাড়তি আগ্রহ থাকবে। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে শান্তিপূর্ণভাবে প্রত্যর্পণের সম্ভাবনা তাতে কিছুটা হলেও বাড়বে।

বাংলাদেশ সরকারের ওপর চীন বা ভারতের চাপ থাকতে পারে এ বিষয়ে। তবে মনে রাখতে হবে সবচেয়ে ওপরে দেশের নিজের স্বার্থ। শুধু ন্যায়বিচারের খাতিরে নয়, রোহিঙ্গাদের ঢল বাংলাদেশে যে অভাবনীয় আর্থসামাজিক সংকট সৃষ্টি করেছে, এটি যে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে, সেগুলো আমাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। মিয়ানমারের শাসক আর সেনাদের বিরুদ্ধে যেকোনো আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির পক্ষে আমাদের তাই জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।

আইসিসির তদন্ত উদ্যোগে ইতিবাচক মতামত প্রদানকে সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখতে হবে। যুক্তি ও তথ্য দিয়ে মানসম্মত মতামত প্রদান করার সামর্থ্য ও সদিচ্ছা সরকারের রয়েছে বলে আমরা বিশ্বাস করতে চাই।

আসিফ নজরুল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক