প্রত্যাশার ভার চাপিয়ে কি ভালো করছি সন্তানদের?

কর্মজীবী মা হওয়ায় সন্তানকে স্কুল থেকে আনা-নেওয়ার সুযোগ মাঝেমধ্যে হয়ে থাকে আমার। কদিন আগে একবার সে সুযোগ হয়েছিল। স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল একজন পরিচিত মায়ের সঙ্গে। তিনি জানিয়েছিলেন সন্তানের পড়াশোনা নিয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা। একপর্যায়ে তিনি আমাকে বললেন, ‘ওর ভালো রেজাল্টের জন্য আর কী করি বলেন তো! চাকরিটা পর্যন্ত ছেড়ে দিলাম। এত কিছু করছি, তারপরও মনমত রেজাল্ট পানি না। শিক্ষকেরাও খুশি না ওকে নিয়ে। এ রকম চলতে থাকলে আমার আর মুখ দেখানোর জায়গা থাকবে না। মরেও শান্তি পাব না।’

ভদ্রমহিলার অভিব্যক্তিতে বেরিয়ে এল তাঁর ভেতরের তীব্র হতাশার বিষয়টি। তাঁর সন্তানটি যেহেতু আমার সন্তানের সঙ্গেই পড়ে, সেহেতু আমি জানি, ছেলেটি পড়াশোনায় বেশ ভালো, ভদ্র এবং শান্ত। মনে মনে ভাবছিলাম, আমাদের লাগামহীন প্রত্যাশার ভার সন্তানের ওপর চাপিয়ে দিয়ে আমরা আরেকটি হতাশাগ্রস্ত ও অস্থির ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করছি না তো! আজ যে এ দেশে লাখ লাখ তরুণ হতাশায় আক্রান্ত, সেই মিছিলে শামিল করার জন্য বোধ হয় আমরা নিজের অজান্তেই বেশ ভালোভাবেই আমাদের সন্তানদের প্রস্তুত করার কাজটি করে চলেছি।

ইদানীং প্রায়ই চোখে পড়ছে সন্তানের লেখাপড়া এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের দায়িত্বজ্ঞানহীন নানা সিদ্ধান্ত, যা অনেক সময় ডেকে নিয়ে আসছে করুণ পরিণতি। তাদের এই হতাশা আর উদ্বেগের কারণে কখনো বা শিশু-কিশোরেরা আত্মহত্যা করছে, কখনো মা সন্তানদের নিয়ে মরতে যাচ্ছেন আবার কখনো বিগড়ে যাচ্ছে সন্তানের মন। পারিবারিক অশান্তির কথা নাহয় না-ই বললাম। ঘটনাগুলোয় দুটি বিষয় স্পষ্ট, আর তা হলো, সন্তানের লেখাপড়া নিয়ে মা-বাবার হতাশা এবং সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁদের অতিরিক্ত উচ্চাশা। চার-পাঁচ বছর বয়সী শিশুরাও বাদ পড়ছে না তাদের এই অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত থেকে। একবার ভাবুন, দুধের বয়সী এই বাচ্চাগুলোর কাছ থেকে মা-বাবার প্রত্যাশা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! তাদের এই প্রত্যাশার মাত্রা কতটা আকাশচুম্বী হলে তা পূরণের ব্যর্থতা থেকে তারা নিজের সন্তানকে হত্যা করায় প্ররোচিত হচ্ছেন। শুধু সন্তানকে হত্যা করেই তারা ক্ষান্ত হচ্ছেন না, তারা নিজেরাও অনেক ক্ষেত্রে বেছে নিচ্ছেন আত্মহননের পথ! কেন আমরা অভিভাবকেরা এ রকম অন্ধ হয়ে উঠছি দিন দিন? কেনইবা এত প্রত্যাশার ভারে আমরা জর্জরিত করছি সন্তানদের জীবন? আমাদের মধ্যে কেন এই সীমাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর পাহাড়সম অনিশ্চয়তা! ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন মনে হলেও তা প্রকৃতপক্ষেÿসন্তানদের নিয়ে অভিভাবকদের হতাশা আর অনিশ্চয়তার সার্বিক চিত্রকেই প্রতিফলিত করে। মনে পড়ে না, শেষ কবে আমি আমার সন্তানদের স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে ওদের সম্পর্কে ইতিবাচক কথা শুনেছি। বাচ্চাদের স্কুলে ত্রৈমাসিক অভিভাবক সভায় হাজিরা দেওয়ার সময় প্রতিবারই ভালো কিছু শোনার প্রত্যাশা নিয়ে স্কুলে উপস্থিত হই। কিন্তু বারবারই ফিরে আসি একরাশ হতাশা নিয়ে।

ব্যক্তিগতভাবে সন্তানদের পরীক্ষার ফলাফল, আচার-আচরণ ইত্যাদি নিয়ে অনেক বাবা-মায়ের কোনো অভিযোগ না থাকলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের অতিরিক্ত প্রত্যাশার ভার বাবা-মায়ের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করেন। শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাঁদের তুলনামূলক মন্তব্য অনেক ক্ষত্রে বাড়িয়ে দিচ্ছে এই হতাশার মাত্রা। তিন-চার বছর বয়সী সন্তান সম্পর্কেও যখন অভিযোগ শুনতে হয়, তখন এই শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে হতাশ হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প পথ থাকে না। শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশও থাকে না অনেক সময়। তবে অনেকেই আছেন, যাঁরা হতাশাকে যুক্তির দৃঢ়তা দিয়ে পরাজিত করতে সক্ষম হন। কিন্তু হতাশাকে শক্তিতে পরিণত করার জন্য যে মানসিক জোর থাকা প্রয়োজন তা সব বাবা-মায়ের থাকে না। অনেক বাবা-মায়ের মধ্যে দিনের পর দিন হতাশার পাল্লা ভারী হতে থাকে, বাড়তে থাকে অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তা।

তথাকথিত নম্বরপত্র কিংবা সনদপত্র সন্তানদের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা মাপার একমাত্র মানদণ্ড হতে পারে না। আমরা শিক্ষকেরা আর অভিভাবকেরা শুধুই ছুটেই চলেছি বাংলা, ইংরেজি, অঙ্কসহ বিভিন্ন বিষয়ে চটকদার নম্বর প্রাপ্তির দৌড়ে। জিপিএ-৫ প্রাপ্ত সন্তানটির নৈতিক মূল্যবোধের স্কোর শূন্য হলেও তাতে আমাদের মাথাব্যথা নেই। প্রচলিত এই নম্বরপত্রে কোথাও থাকে না একজন শিক্ষার্থী একজন সর্বাঙ্গীণ সুন্দর মানুষ হয়ে ওঠার দৌড়ে কতখানি যোগ্যতা অর্জন করেছে সে বিষয়টি। এই নম্বরপত্র বলে না শিক্ষার্থীটি কতটা সৎ, কতটা সামাজিক, কতটা পরোপকারী, কতটা পরমতসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। তাই অনন্য এই মানবিক মূল্যবোধগুলো নিয়ে যে শিশুটি বড় হয়ে উঠছে, সেও হয়তো প্রশংসিত হয় না আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়; প্রশংসিত হয় না তার বাবা মা।

শিশুদের জীবন আজ যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র। সব শিশুই অবতীর্ণ হয়েছে সেই যুদ্ধে। শুধু তারাই নয়, সেই ইঁদুরদৌড়ে শামিল হয়েছে তাদের অভিভাবকেরাও। তাই শিশুরা সামান্য পিছিয়ে পড়লেই হতাশ হয়ে পড়ছেন অভিভাবকেরা। এত মানসিক চাপে থাকা শিশুদের ইতিবাচক পরিবর্তন কি আদৌ সম্ভব! শিশুরা পড়াশোনার পাশাপাশি গান, নাচ, কবিতা, ছবি আঁকা, মার্শাল আর্ট—অনেক কিছুই শিখছে। কিন্তু তীব্র প্রতিযোগিতামূলক প্রবণতার কারণে এসব সুকুমারবৃত্তির চর্চা করেও অনেক ক্ষত্রে শিশুদের মনোজগতের যে পরিবর্তন ঘটার কথা, তা ঘটছে না। আজকের শিশুদের কেউ বলে না, সহপাঠীর প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ানোর কথা, টিফিন ভাগ করে খাওয়ার কথা, দলগতভাবে খেলাধুলা করার কথা। শিশুরা যেন একেকটি যন্ত্র! তারা যেন আলাদা আলাদা গ্রহের বাসিন্দা। স্কুলের গেটে অপেক্ষমাণ মায়েরা সন্তানদের নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোজ সংগ্রহ করেন প্রতিযোগিতা করার এবং হতাশায় ভোগার নতুন নতুন রসদ। কার বাচ্চা কোথায় গান শিখছে, মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, কোচিং করছে, কোন প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে, কোন রেস্টুরেন্টে খাচ্ছে, কার বাড়িতে কত বড় পার্টি হচ্ছে—এসবের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা ভুলে যাচ্ছি আমাদের সন্তানদের সত্যিকার ভালো লাগার জায়গাটি খুঁজে বের করতে।

বন্ধ হোক শিশুদের নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষার এই প্রতিযোগিতা। আসুন, আমরা শামিল হই আমাদের সন্তানদের প্রকৃত অর্থে মানুষ করার যুদ্ধে। কী হলো না, কী পেলাম না, প্রতি মুহূর্তে সেটি বিশ্লেষণ না করে বরং আমরা ফিরে তাকাই আমাদের প্রাপ্তির খাতায় এবং যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করি প্রত্যাশার সীমারেখা। যে হতাশার যুদ্ধ বাঁচতে দেয় না চার-পাঁচ বছর বয়সী শিশুকে সেই প্রতিযোগিতাকে আমরা ঘৃণা করতে শিখি। আমরা স্কুলগুলোকে সম্মিলিতভাবে বলতে শিখি স্কুলের দায়িত্ব শিশুদের মধ্যে আশার সঞ্চার করা, হতাশার বীজ ছড়ানো নয়। শিক্ষা মানে সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটানো নয়; বরং সম্ভাবনার বিকাশ ঘটানো। আসুন, আমরা অভিভাবকেরা রুখে দিই শিশুদের যন্ত্রমানব বানানোর সব প্রচেষ্টা। নিজেরা সুখী হই, সুখী করি আমাদের সন্তানদের। নিজেরা বাঁচি, বাঁচাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক