অন্ধ হয়ে প্রলয় ভুলছেন বিশ্বনেতারা

প্রতিরক্ষার দোহাই দিয়ে জাতিতে জাতিতে অস্ত্র প্রতিযোগিতা আগেও ছিল, এখনো আছে। আগেকার দিনে মূলত পার্শ্ববর্তী রাজ্যের সঙ্গে চলত এই প্রতিযোগিতা। হিসাব চলত পদাতিক, ঘোড়সওয়ার ইত্যাদি নিয়ে। এর পরে বন্দুক-কামান হয়ে পৃথিবীর ইতিহাস অনেক দূর এগিয়েছে। এখন যুগ পারমাণবিক অস্ত্রের, আকারে-প্রকারে যা ভীষণ বিধ্বংসী। এখন যুগ ক্ষেপণাস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী প্রতিরক্ষাব্যবস্থার। সবার কাছে নেই এই অস্ত্র। কিন্তু যাদের কাছে যতটা আছে, তা-ই যথেষ্ট এই পৃথিবীকে ধূলিসাৎ করে দেওয়ার জন্য। ভীষণ বিধ্বংসী ক্ষমতা জানে বলেই পরস্পরের প্রতি সন্দেহ পোষণ করা দেশগুলো নিজেদের মধ্যে কিছু চুক্তিতে উপনীত হয়েছে। এ চুক্তিগুলোই বিশ্বের পারমাণবিক অস্ত্রহীন দেশগুলোকে কিছুটা নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু এখন অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিশ্বনেতারা যেন এই সত্য ভুলতে বসেছেন। অন্ধের ভান করে তাঁরা যেন প্রলয়কে আড়াল করতে চাইছেন।

প্রথমে আশাবাদের কথা বলে নেওয়া যাক। এ আশা উত্তর কোরিয়া নিয়ে। আসছে মাসে সিঙ্গাপুরে বসছেন উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং-উন ও আমেরিকার নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প। উদ্দেশ্য, উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্র সম্প্রসারণ কার্যক্রম থেকে ফিরিয়ে আনা। বিনিময়ে উত্তর কোরিয়া চায় বিশ্ব, তথা আমেরিকার দিক থেকে নিরাপত্তার গ্যারান্টি। এখন পর্যন্ত দক্ষিণ কোরীয় নেতা মুন জে-ইনের মধ্যস্থতায় এ-সম্পর্কিত আলোচনা বেশ অগ্রসর হলেও সংশয় রয়ে গেছে। সংশয়ের একদিকে কিম পরিবারের অতীত ইতিহাস; অন্যদিকে আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। দুই-ই অননুমেয়। দ্য ইকোনমিস্ট তো কিম পরিবারকে সরাসরি ‘সিরিয়াল চিটস’ বা ‘ধারাবাহিক প্রতারক’ হিসেবেই আখ্যা দিয়েছে। একই সঙ্গে বলেছে, পরমাণু কর্মসূচিই কিম পরিবারের ক্ষমতায় আরোহণের সিঁড়ি। ফলে কিম উন এই সিঁড়ি একেবারে হারাতে চাইবেন না। তবু অনেকেই বহুল আকাঙ্ক্ষিত আলোচনায় শুভ কিছু আসবে বলেই আশা করছেন।

কিন্তু এই আশার ঘরেই হতাশা পাত পেতেছে। আর তা সামনে এসেছে ইরান চুক্তিকে পায় দলে ৮ মে দেওয়া ট্রাম্পের ঘোষণার মধ্য দিয়ে। এর চেয়েও ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, যখন এ দৃশ্যে রাশিয়াও প্রবেশ করে। আগামী তিন বছরের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র সীমিতকরণে রাশিয়ার সঙ্গে হওয়া আমেরিকার চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে। আর এই চুক্তি নবায়নের কোনো উদ্যোগ এখনো দেখা যায়নি। শেষ পর্যন্ত এটি নবায়ন না করা হলে ক্ষমতাধর দুই দেশের পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ গত অর্ধশতকের মধ্যে প্রথমবারের মতো বিধিনিষেধের বাইরে চলে যাবে। আর তেমনটি হলে আশির দশকের চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি ফিরে আসতে পারে, যখন পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই দেশ শুধু তথ্যবিভ্রাট ও সন্দেহের বশবর্তী হয়ে পরস্পরের দিকে তাক করে রেখেছিল তাবৎ ক্ষেপণাস্ত্র। ওই ঘটনা ইতিহাসে ‘কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকট’ নামে পরিচিত। সৌভাগ্য, কোনো যুদ্ধ ছাড়াই সে যাত্রা সংকট উতরে গিয়েছিল। পরে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব ঠেকাতে দাওয়াই হয়ে হাজির হয় বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি। এই চুক্তিগুলোই এখন পর্যন্ত আস্থার স্থল। কিন্তু শঙ্কা ফিরে আসছে আবার। কারণ, শান্তির বিপরীতে শৌর্য-বীর্যের পুরোনো সমীকরণ কষতে শুরু করেছেন বিশ্বনেতারা। আগেকার চেয়ে অনেক বেশি প্রাযুক্তিক সক্ষমতা ও আঞ্চলিক উত্তেজনার সূত্র ধরে বিশ্বব্যাপী তৈরি হচ্ছে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কার্যক্রম সম্প্রসারণের বিপদ। যেকোনো সময় যেকোনো ধরনের তথ্যবিভ্রাট কিংবা মুহূর্তের ভুল সিদ্ধান্তে পৃথিবী বদলে যেতে পারে।

ইকোনমিস্ট বলছে, ইরান চুক্তি বাতিলের মধ্য দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তিবিরোধীদের তত্ত্বকেই সামনে নিয়ে এল। এরা সাধারণত যেকোনো অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তির ঘাটতির দিকেই মনোযোগ আকর্ষণ করে, একে ‘অহেতুক’ অভিধা দিয়ে ছুড়ে ফেলার পরামর্শ দেয়। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পের বর্তমান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনের কথা বলা যায়। ইরান চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া বোল্টনের যুক্তি ছিল, এই চুক্তি ইরানকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ ও প্রতিবেশীদের হুমকি-ধমকি দেওয়া থেকে বিরত করছে না। কিন্তু এটি কখনোই জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) বা ইরান চুক্তির শর্তের মধ্যে ছিল না। বরং ওই চুক্তি অন্তত ১০ বছরের জন্য ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রেখেছিল। একই সঙ্গে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ইউরেনিয়ামের মজুত কমিয়ে আনার শর্ত ছিল। বিনিময়ে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারসহ কিছু আর্থিক সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল ইরানের। কিন্তু পশ্চিম বিনিময়টি যথাযথভাবে পরিশোধ না করলেও ইরান ঠিকই শর্ত মেনেছিল।

নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, আমেরিকার ইরান চুক্তি বাতিলের মধ্য দিয়ে পুরো বিশ্ব এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য আরও বেশি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ার তীব্র আশঙ্কা রয়েছে। অন্য পাঁচ দেশ এই চুক্তি অব্যাহত রাখার কথা বললেও আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার মধ্যে তা কতটা যথাযথভাবে পরিপালন করা সম্ভব হবে, তা নিয়ে রয়েছে ঘোর সংশয়। এ অবস্থায় ইরান চাইলে ইউরেনিয়াম মজুত বৃদ্ধির কার্যক্রম আবার শুরু করতে পারে। এ ধরনের ইঙ্গিত এরই মধ্যে এসেছে দেশটির পক্ষ থেকে। তেমনটি হলে পারমাণবিক অস্ত্রের সম্প্রসারণ রোধে সবচেয়ে কার্যকর বৈশ্বিক চুক্তি নন-প্রোলিফারেশন ট্রিটি (এনপিটি) কাগুজে হয়ে উঠতে পারে। এ অবস্থায় সৌদি আরব, মিসরসহ অঞ্চলটির বড় শক্তিগুলো নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে পরমাণু কর্মসূচি জোরদার করতে পারে বলে স্পুটনিক নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন গ্লোবাল পলিসি ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট ও বিএইউ আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক পাওলো ভন শিরাক। ইউএসএআইডির এই সাবেক পরামর্শক বলেন, ‘এতে পরমাণু কর্মসূচি সম্প্রসারণ ও ইউরেনিয়াম মজুত বৃদ্ধিতে ইরানের সামনে আর কোনো বাধা থাকল না। ফলে সৌদি আরব ও মিসর পরমাণু কর্মসূচিকে জোরদার করতে পারে।’

একই সঙ্গে এই পরিস্থিতি উত্তর কোরিয়া নিয়ে বিদ্যমান আশার গুড়ে বালু ঢালতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। কারণ, এখন আমেরিকার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার সামনে লিবিয়ার উদাহরণ আছে, যেখানে পশ্চিমের চাপে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কার্যক্রম স্থগিত করেছিল দেশটি; আর পরে পশ্চিমেরই কলকাঠিতে ছিন্নভিন্ন হয়েছিল তারা।

সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ও বিধ্বংসী ক্ষমতার দিক থেকে আমেরিকা আবারও বিশ্বের শীর্ষ দেশ হতে চাইছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এরই মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতায় শীর্ষ স্থান দখলের ইচ্ছার কথা সোচ্চারে বলেছেন। এই আকাঙ্ক্ষার প্রমাণ চাইলে চোখ রাখা যেতে পারে গত বছরের ৯ আগস্টে ট্রাম্পের এক টুইটার পোস্টের দিকে, যেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমাদের পারমাণবিক অস্ত্রের নবায়ন ও আধুনিকায়নের নির্দেশই ছিল প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার প্রথম আদেশ। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আমরা এখন অনেক বেশি শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান।’

এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে ট্রাম্প একজন যোগ্য উপদেষ্টাই পেয়েছেন বলা যায়। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হওয়ার আগে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে লেখা নিজের নিবন্ধে জন বোল্টন বলেছিলেন, ‘উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে সেখানে প্রথম আঘাত হানার সব ধরনের বৈধতা আছে আমেরিকার।’ হয়তো এমন আগ্রাসী বক্তব্যের কারণেই ট্রাম্প প্রশাসনে জায়গা করে নিয়েছেন বোল্টন।

এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা ১৯৭২ সালে রাশিয়ার সঙ্গে হওয়া আমেরিকার কৌশলগত অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তির ভবিষ্যৎকে ঝুঁকিতে ফেলছে। একই সঙ্গে ২০১০ সালে মস্কো ও ওয়াশিংটনের মধ্যে হওয়া নতুন কৌশলগত অস্ত্র হ্রাসকরণ চুক্তির (নিউ স্টার্ট) নবায়ন নিয়েও তৈরি হয়েছে সংশয়। বর্তমানে এই চুক্তির কারণে দুই দেশেই ১ হাজার ৫৫০টি করে নিউক্লিয়ার ওয়্যারহেড আছে। ২০২১ সালের মধ্যে এই চুক্তি নবায়ন না হলে দুই দেশের মধ্যে এ-বিষয়ক তথ্য বিনিময়, অস্ত্র তৈরির কার্যক্রম সম্প্রসারণসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আর কোনো পারস্পরিক বাধ্যবাধকতা থাকবে না। অর্থাৎ স্নায়ুযুদ্ধকালীন অস্ত্র প্রতিযোগিতার দ্বার উন্মুক্ত হবে আবার।

এখানেই শেষ নয়। ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস (আইএনএফ) চুক্তিও হুমকির মুখে। কারণ, রুশ ও মার্কিন দুই পক্ষ থেকেই এই চুক্তি নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছে। কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের পর ১৯৮৭ সালে রোলাল্ড রিগ্যান ও মিখাইল গর্বাচেভের মধ্যে এই চুক্তি হয়েছিল। এর আওতায় ৫০০ থেকে ৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটার রেঞ্জের ২ হাজার ৭০০ গ্রাউন্ড-লঞ্চড (স্থলভাগ থেকে ছোড়া যায়) ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করা হয়েছিল। কিন্তু এখন উভয় পক্ষই একে অন্যের দিকে আঙুল তুলে এই চুক্তি বরখেলাপের অভিযোগ তুলছে। আর ট্রাম্পের নিরাপত্তা উপদেষ্টা বোল্টন এর সঙ্গে চীনকে যুক্ত করার এক অসম্ভব প্রস্তাব তুলেছেন। ফলে আইএনএফের ভবিষ্যৎও খুব একটা উজ্জ্বল নয়।

কথা হচ্ছে, সুনিশ্চিত বিপর্যয় জেনেও কেন এই অস্ত্র প্রতিযোগিতায় মাতছে বিশ্ব। আমেরিকার দিকে তাকানো যাক। ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল বলছে, ‘পারমাণবিক চুল্লি বিক্রয়কে মার্কিন প্রশাসন এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। কারণ, আমেরিকার এ-সম্পর্কিত ব্যবসা বর্তমানে মন্দাভাব চলছে।’ একই অবস্থা বিশ্বের অন্য শক্তিগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বিশ্বব্যাপী একটি পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতাই এই মন্দাভাব কাটাতে পারে। আগে ব্যবসা, পরে ঝুঁকি। আর ব্যবসাতে তো ঝুঁকি থাকবেই। সহজ সমীকরণ।