খুলনায় 'চমৎকার' নির্বাচন হয়েছে!

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের হালচাল দেখে প্রয়াত সাংবাদিক নির্মল সেনের একটি কলামের কথা মনে পড়ল। তিনি লিখেছিলেন, ‘হরতাল হয়েছে, হরতাল হয়নি’। তখন ছিল ‘হরতাল যুগ’। যেকোনো হরতালের পর সরকারি দলের নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে বলতেন, জনগণ বিরোধী দলের হরতালকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আর বিরোধী দলের নেতারা আওয়াজ তুলতেন, ‘সফল হরতালের মাধ্যমে মানুষ সরকারের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে।’

নির্মল সেন সরকারি মালিকানাধীন পত্রিকায় চাকরি করতেন। সেই সঙ্গে একটি দলেরও প্রধান ছিলেন তিনি। বিকেলে জনসভায় সরকারের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে এসে রাতে পত্রিকা অফিসে কাজ করতেন। সামরিক শাসনামলেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। কিন্তু এখন সে রকম দৃশ্যের কথা ভাবা যায় না।

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের বক্তব্য অনেকটা নির্মল সেনের কলামের শিরোনামের মতো। আওয়ামী লীগ জোর দিয়ে বলেছে, খুলনায় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। বিএনপি হেরে গিয়ে ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে। আর বিএনপি আরও বেশি শক্ত ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, খুলনায় নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছে। সরকার নির্বাচনী ব্যবস্থাটিকে ধ্বংস করেছে।

বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু গতকাল সংবাদ সম্মেলনে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ১০৫ কেন্দ্রে ‘ভোট ডাকাতি’ হওয়ার কথা উল্লেখ করে এসব কেন্দ্রে ফের ভোট নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থী তালুকদার খালেকের পাল্টা বাহাস হলো, নির্বাচন কমিশন ও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতেই বিএনপি প্রার্থী মনগড়া অভিযোগ এনেছেন। দু-একটি কেন্দ্রে বিচ্ছিন্নভাবে যে বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটেছে, সেটি কাউন্সিলর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। মেয়র নির্বাচন ছিল ফকফকে সাদা।

দুই তরফের এই পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের কোনটি ঠিক? একই সময়ে একই নদীতে যেমন জোয়ার ও ভাটা হতে পারে না, তেমনি নির্বাচনের নামে প্রহসন ও সুষ্ঠু নির্বাচনও একসঙ্গে চলতে পারে না। এ ব্যাপারে গতকাল খুলনার নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধির দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি জানান, এক অর্থে দুই পক্ষই ঠিক। নির্বাচন নিয়ে অনেকের শঙ্কা ছিল বড় ধরনের সন্ত্রাস ও সহিংসতা হবে। সেটি হয়নি। দৃশ্যত কেন্দ্রের বাইরের চেহারা ছিল শান্ত। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে ভোট কারচুপি হয়েছে। বাইরে সুনসান। ভেতরে নানা কারসাজি। সাধারণত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পোলিং এজেন্টরা ভোট কারচুপি ঠেকান। কিন্তু অনেক কেন্দ্রেই বিএনপি প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট যেতেই পারেননি।

দুই দলের এই পাল্টাপাল্টি কথার মধ্যেই নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ আরেক ধাপ এগিয়ে বললেন, ‘চমৎকার’ নির্বাচন হয়েছে। সংসদ বাংলা অভিধান অনুযায়ী, চমৎকার শব্দের অর্থ আশাতীত সুন্দর বা ভালো। চমক লাগানোর মতো ভালো। এর অর্থ দাঁড়ায় সচিব মহোদয় এতটা ভালো নির্বাচন আশা করেননি। নির্বাচন সম্পর্কে যে বিশেষণ সরকারদলীয় নেতারাও ব্যবহার করতে কুণ্ঠিত, সেই বিশেষণ যখন কমিশনের কর্মকর্তার মুখ থেকে আসে, তখন বলতে হয়, শাবাশ বাংলাদেশ।

খুলনা নির্বাচনের বিতর্ক আরও কিছুদিন চলবে। বিএনপি নেতারা ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে পুরো নির্বাচন প্রত্যাখ্যান ও সিইসি কে এম নুরুল হুদার পদত্যাগ দাবি করেছেন। একটি নির্বাচন তখনই চমৎকার হয় যখন সেই নির্বাচনে কোনো অনিয়ম না ঘটে। ইসি সচিব না হয় বিএনপির প্রার্থী ও নেতাদের অভিযোগ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন। কিন্তু গণমাধ্যমে ভোট জালিয়াতি, ব্যালট পেপারে পাইকারি ছাপ্পা মারার যেসব ছবি প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে, সেগুলো কীভাবে অস্বীকার করবেন? তিনি বলেছেন, ‘মোট ২৮৯টি কেন্দ্রের মধ্যে তিনটি কেন্দ্র স্থগিত হয়েছে। বাকি কেন্দ্রগুলোয় শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে।’ কিন্তু গণমাধ্যমগুলোতে বিপরীত চিত্রই উঠে এসেছে। ওই তিনটির বাইরে বহু কেন্দ্রে নীরব কারচুপির ঘটনা ঘটেছে। প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘নগরীর ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের নুরানি বহুমুখী মাদ্রাসা কেন্দ্রে স্থানীয় নৌকা-সমর্থিত প্রভাবশালী ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষণ দলের এক সদস্যকে অপদস্থ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কেন্দ্রটিতে দুপুর ১২টার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, এক ব্যক্তি তাঁর দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে বের হচ্ছেন। বাবা-ছেলের দুজনের হাতের আঙুলে ভোট দেওয়ার সময় লাগানো অমোচনীয় কালি দেখে এই প্রতিবেদক তাঁদের অনুসরণ করেন। একপর্যায়ে ভোট দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আমার ছেলেও ভোট দিয়েছে।’ দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলেটি বলে, ‘নৌকায় ভোট দিয়েছি। টিপু আঙ্কেলকে ভোট দিয়েছি (আওয়ামী লীগের স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী আলী আকবর টিপু, প্রতীক ঠেলাগাড়ি)।’ যে নির্বাচনে দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ভোট দিতে পারে, সেটি চমৎকার নির্বাচনই বটে।

বেলা দুইটার দিকে খুলনা পিটিআই কেন্দ্রে সরেজমিনে দেখা যায়, সাদিয়া পারভীন নামের একজন ভোটার ভোট দিতে গিয়ে তিনি ভোট দিতে পারেননি। তিনি নগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব বানিয়া খামার এলাকার বাসিন্দা। তাঁর ভোট দেওয়ার কথা ছিল খুলনা পিটিআই কেন্দ্রের পরীক্ষণ ভবনে। সাদিয়া পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ভোট দিতে গেলে ওনারা বলেন, “ভোট হয়ে গেছে। অন্যখানে যান। ” ’ (প্রথম আলো, ১৬ মে ২০১৮)।

প্রথম আলোর প্রতিবেদক ও আলোকচিত্রীরা খুলনার ৮০টি ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখেছেন। এর মধ্যে তাঁরা ৬০টি কেন্দ্রে ধানের শীষের কোনো পোলিং এজেন্ট দেখতে পাননি। নির্বাচন কমিশন হয়তো বলবে, কোনো প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট না এলে তাঁদের কী করার আছে। নিশ্চয়ই করার আছে। বিএনপি বা অন্য দলের প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট কেন্দ্রে এলে আক্রান্ত হবেন না, সেই নিশ্চয়তা তো তাঁরা দিতে পারেননি। ইসি কতটা সততা ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষের কাছে সেটি বিশ্বাসযোগ্য করা। খুলনায় তিন দিন অবস্থানকালে সেখানকার বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছিল, নির্বাচন নিয়ে তাঁদের মনে শঙ্কা আছে। ইসি এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি, যাতে সেই শঙ্কা কেটে যায়। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের চাকরি যে তাদের হাতে ন্যস্ত, সেটাও ইসি প্রমাণ করতে পারেনি। তারা আগে যেমন সরকারের অধীনে ছিল, নির্বাচনের সময়ও সেভাবেই কাজ করেছে। ফলে অনেকেই মনে করেছেন, ফলাফল পূর্বনির্ধারিত।

তবে নির্বাচনে পরাজিত বিএনপিও কম অদূরদর্শিতার পরিচয় দেয়নি। তারা খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে নিয়েছেন জাতীয় ইস্যু তথা গণতন্ত্র উদ্ধার ও দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার কারামুক্তির ইস্যু হিসেবে। কিন্তু খুলনার ভোটাররা নিজেদের সমস্যা নিয়েই বেশি বিচলিত ছিলেন। বিএনপির বালখিল্য আচরণের আরেকটি উদাহরণ হলো এভিএম বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন চালুর বিরোধিতা। অথচ সংশ্লিষ্টদের মতে, এই পদ্ধতিই হয়তো তাদের রক্ষা করতে পারত। বিএনপির বিরোধিতা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন দুটি কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে জিএম পদ্ধতিতে ভোট নিয়েছে। ফলাফলে দেখা গেছে, দুটি কেন্দ্রের একটিতে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক। তিনি পেয়েছেন ৭৭৭ ভোট। আর ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিএনপির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু পেয়েছেন ৭১০ ভোট। অপরটিতে জয়ী হয়েছেন বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু। পেয়েছেন ৫১১ ভোট। আর তালুকদার খালেক ৫০৫ ভোট।

সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শুরু থেকে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে চাপে রাখার যে কৌশল নিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত সেটি ধরে রেখেছিল। বিএনপির নেতা-কর্মীরা যাতে কোনোভাবে মাঠ থাকতে না পারেন, সেই চেষ্টাই তারা করেছে এবং কার্যত সফলও হয়েছে। আসলে খুলনার জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল ১৫ মের আগেই। আওয়ামী লীগ নির্ভার ছিল। আর প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের সেই নির্ভরতা বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে খুলনাবাসী একটি ‘সন্ত্রাসমুক্ত’ নির্বাচন পেলেও সুষ্ঠু নির্বাচন পাননি।

খুলনার এই ফলাফল নির্বাচন গাজীপুর কিংবা পরবর্তী বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কী প্রভাব ফেলবে, সেটি জানার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan 55 @gmail. com