কী আশ্চর্য-সুন্দর মাধুর্যের এক জীবন

ফারুক আহমদ চৌধুরী
ফারুক আহমদ চৌধুরী

বিশ্বাসই হতে চায় না ফারুক ভাই (ফারুক চৌধুরী) তাঁর অতি প্রিয় এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে গেছেন, তা-ও এক বছর হলো। এই পৃথিবী, এই পরিবেশ, এই পারিপার্শ্বিকতা, এই প্রকৃতি, এই মানুষ, এই সমাজ—তাঁকে ঘিরে যা কিছু আছে, সবকিছুকেই ফারুক ভাই অত্যন্ত গভীরভাবে ভালোবাসতেন। জীবনকে এত প্রচণ্ড নিবিড়তায় ভালোবেসে তা থেকে নির্যাস নিংড়ে নিয়ে নিজের বেঁচে থাকাকে এত বিচিত্রভাবে সমৃদ্ধ তিনি করতে পেরেছিলেন, যার অনুপম প্রকাশ আমরা দেখেছি তাঁর রচিত বই ও প্রবন্ধসমূহে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত পরিপূর্ণভাবে বেঁচে থেকে তিনি অপ্রতিরোধ্য চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে গেছেন।

জীবনকে উপভোগ্য করার সব উপকরণকেও বড় ভাই (ফারুক ভাই) মর্যাদা দিতেন। এর মধ্যে অবশ্যই ছিল চারুশিল্প, সংগীত, সাহিত্য, ক্রীড়া, সামাজিকতা এবং গান-আহার। বই কেনা, বই পড়া ও আলোচনা ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। তাঁর বাড়ি তো হয়ে উঠেছিল একটি মিনি চিত্রশালা। ভাবি জীনা চৌধুরীরও চিত্রশিল্প এবং অন্যবিধ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে রয়েছে প্রচুর উৎসাহ। উভয়ে অনেক পেইন্টিং সংগ্রহ করেছিলেন। বাংলাদেশের সব প্রথিতযশা শিল্পীর সৃষ্টি এর মধ্যে রয়েছে। সামাজিকতা ও আড্ডা তাঁর দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল। বিভিন্ন কুইজিনে ছিল তাঁর তুমুল উৎসাহ। খ্যাতনামা অনেক ‘শেফের’ সঙ্গে ছিল তাঁর যোগাযোগ। তিনি ছাড়া আমি কারও কথা শুনিনি যে অসুস্থ অবস্থায়ও লন্ডন থেকে ট্যাক্সিতে করে মাইল পঞ্চাশেক দূরে একটি মিশেলিন তারকাপ্রাপ্ত রেস্তোরাঁয় কোনো এক খ্যাতনামা ‘শেফের’ প্রস্তুত মাছের কোনো এক সৃষ্টির স্বাদ গ্রহণ করতে গিয়েছেন। দুর্নিবার বড় ভাই ও জীবনসঙ্গিনী ভাবি জীনা বিভিন্ন প্রতিকূলতা জয় করে এ ধরনের বহু অ্যাডভেঞ্চার করেছেন শুধু জীবনের বিভিন্নমুখী তৃপ্তির স্বাদ পাওয়ার জন্য।

নিঃসন্দেহে তিনি একজন অত্যন্ত সফল ও কৃতী কূটনীতিক ছিলেন। ভাগ্যক্রমে তাঁর মেধা ও নৈপুণ্য দেখানোর বা কাজে লাগানোর সুযোগও পেয়েছেন। কর্মজীবন শুরু হয় রোমে। সেখানে তাঁর কর্মতৎপরতা এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে অবদানের জন্য ইতালীয় সরকারের সম্মানসূচক পদবি ক্যাভালিয়ারি পান ১৯৬১ সালে। তারপরই তাঁকে পাঠানো হলো বেইজিং। ওই সময়টা ছিল তাঁর কূটনৈতিক জীবনের অন্যতম চ্যালেঞ্জিং সময়। দীর্ঘ আলোচনার পর তখন চীন-পাকিস্তান সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং চীন-পাকিস্তানের মৈত্রী একটি সুদৃঢ় ভিত্তিতে রচিত হলো। ওই সময় তিনি চীনের চৌ এন লাই-এঁদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পান। এমনকি চেয়ারম্যান মাও সে-তুং এবং চীনের সর্বশেষ সম্রাট পু ই রও ব্যক্তিগত পরিচিতির সম্মান লাভ করেন। মাওলানা ভাসানীর অত্যন্ত সফল এক সফরের সংগঠক ছিলেন তিনিই।

পরবর্তী সময়ে যেখানেই তিনি গেছেন, কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। দ্য হেগ, আলজিয়ার্স। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর লন্ডনে প্রথম বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার, সংযুক্ত আরব আমিরাতে, ব্রাসেলসের ইউরোপীয় কমিশন এবং পার্শ্ববর্তী বেনেলুক্সে, দীর্ঘ সময় দিল্লিতে রাষ্ট্রদূত হিসেবে তিনি অর্জন করেছিলেন কৃতিত্ব ও সাফল্য। ঢাকায় তিনি ছিলেন স্বল্পকালীন রাষ্ট্রাচারপ্রধান-স্বাধীনতার পরপরই। দিল্লিতে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে পাকিস্তান প্রত্যাগত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাঁর সফরসঙ্গ অনুষঙ্গী হিসেবে ঢাকায় এলেন। বহু দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি বা দলীয় নেতা হিসেবে করেছেন অংশগ্রহণ। পররাষ্ট্রসচিবের দায়িত্বও পালন করেন সুচারুরূপে। তাঁর এই বর্ণাঢ্য ও সফল কূটনৈতিক জীবনকাহিনির বিস্তৃত কৌতূহলোদ্দীপক বর্ণনা আছে তাঁর রচিত কয়েকটি বইয়ে, বিশেষ করে দেশ-দেশান্তর এবং জীবনের বালুকাবেলায় বই দুটিতে।

তীব্র ছিল তাঁর সমাজ সচেতনতা, যার তাড়না বোধ করি কূটনীতিক-উত্তরকালে ব্র্যাকে তাঁর জীবনে ফলপ্রসূ এবং উপভোগ্য করে তুলেছিল। তিনি ছিলেন ব্র্যাকের অন্যতম উপদেষ্টা, সংস্থাটির পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এবং ডেল্টা-ব্র্যাক হাউজিংয়ের চেয়ারম্যান। সমাজ, মানুষ, বন্ধুবান্ধব, প্রকৃতি, নিসর্গ, পরিবেশ-সবকিছু তিনি গভীরভাবে ভালোবাসতেন। আমার কাছে মনে হতো অবিচ্ছেদ্য এই যোগসূত্র। এসব ছিন্ন করে তিনি যে চলে গেছেন, তা ভাবতে আমার খুবই কষ্ট হয়।

অনেক কলাম ও এগারোটি বই তিনি লিখেছেন। সব কটিই সুখপাঠ্য এবং উন্নত মানের। বিভিন্ন স্বীকৃতি ও বাংলা একাডেমি অ্যাওয়ার্ড-প্রাপ্ত। ইংরেজি, বাংলা দুই ভাষাতেই ছিল তাঁর ব্যুৎপত্তি। তবে সব কটি বইই বাংলায় লিখেছেন। তার মধ্যে দেশ-দেশান্তর, প্রিয় ফারজানা, সময়ের আবর্তে এবং জীবনের বালুকাবেলায় ঈর্ষণীয়ভাবে পাঠক সমাদৃত। তাঁর লিখিত সর্বশেষ বই অনাবিল মুখচ্ছবিতে আমাদের চেনা বাংলাদেশের, আমাদের সমসাময়িক পৃথিবীর, আমাদের জীবনের ভুবনে যারা পরিচিতজন, তাঁদের আপন বৈশিষ্ট্য চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। তাতে রয়েছে বিচিত্র মানুষের গল্প, মানুষের বৈচিত্র্যের গল্প, বিচিত্র মানুষের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানবিকতার গল্প। তাঁর ছিল একটি অসাধারণ কৌতুকপ্রিয় সত্তা, যা তাঁর সঙ্গ বা নৈকট্যকে আকর্ষণীয় করে তুলত। উপরন্তু নিজেকে নিয়ে কৌতুক বা আমোদ করার একটি আশ্চর্য সুন্দর ক্ষমতা তাঁর ছিল। বিদ্রূপ আর কৌতুকের মধ্যে যে একটি অপস্রিয়মাণ বা অপরিদৃশ্যমান ভেদরেখা আছে, তা নিয়ে তিনি সদা সজাগ ছিলেন।

জন্মলগ্ন থেকে তো আমার জীবনজুড়ে ছিলেন তিনি। কাছে থাকি, দূরে থাকি-যাই হোক, নিবিড় নৈকট্যবোধের ঘাটতি কখনো ছিল না। আমি যেখানে থেকেছি, সেখানেও তিনি এসেছেন। সত্যি বলতে কি, আমার জীবনে এমন কোনো সময় নেই, দিক নেই, যেখানে ছিল না তাঁর সরব উপস্থিতি। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, ছোটবড়-পরিচিত-আগন্তুক-জাতি-ধর্ম-মতামতনির্বিশেষে সবাইকে অতি সহজে কাছে টেনে নিয়ে পরম আন্তরিকতায় আপন করে নেওয়ার দুর্লভ গুণ, বিরল ক্ষমতা, অতীব স্বাভাবিকতায় তাঁর আচরণ, মনোভাব, অনুভূতিতে বিরাজ করত। এবং তা প্রকাশ পেত সব সময়।

বড় ভাইয়ের বিদায় আমাদের জীবনে সৃষ্টি করেছে এক বিরাট অপূরণীয় শূন্যতা। আজ যখন অস্তাচলের কাছে এসে পেছনে তাকাই-জীবনে হেঁটে আসার সেই পায়ে চলার পথ বেয়ে-‘বাতাসে চেনা দিনের গন্ধে আর আধ ভোলা কান্না-হাসির মাঝে; ফারুক ভাই কী আশ্চর্য-সুন্দর মাধুর্যে দেদীপ্যমান। আমার জীবনে, আমাদের অনেকেরই জীবনে সেটাই তাঁর চিরকালের আসন।

ইনাম আহমদ চৌধুরী: অর্থনীতিবিদ ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা