জিন্নাহ ও নামাজ, মেরুকরণের সলতে

জিন্নাহর ছবি নিয়ে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি উত্তেজনা দেখা দেয়
জিন্নাহর ছবি নিয়ে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি উত্তেজনা দেখা দেয়

দুই রাজ্যই বিজেপি-শাসিত। একটি ‘মিনি ইন্ডিয়া’, যার পোশাকি নাম উত্তর প্রদেশ, অন্যটি হরিয়ানা। যে দুই ঘটনা এই দুই রাজ্যে প্রায় পিঠাপিঠি ঘটে গেল, তার কোনোটার মীমাংসা এখনো পুরোপুরি হয়নি। ছাইচাপা আগুন হয়ে রয়েছে। জনমানস তোলপাড়। অথচ প্রত্যাশিতভাবে নীরব প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি!

প্রথমে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের (এএমইউ) ঘটনাটা বলি। তারপর নাহয় গুরুগ্রামের গোলমাল নিয়ে কথা বলা যাবে।

উত্তর প্রদেশের ঐতিহাসিক আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়ন ভবনের দেয়ালে পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একটি ছবি আছে। ছবিটা টাঙানো হয়েছিল পাক্কা ৮০ বছর আগে। ১৯৩৮ সালে। জিন্নাহর আগে যাঁর ছবি ওই ভবনে স্থান পেয়েছিল, তিনি মহাত্মা গান্ধী। ওই ভবনে আরও অনেক কৃতী ভারতীয়র ছবি রয়েছে। যেমন ভীমরাও আম্বেদকর, রাজেন্দ্র প্রসাদ, মাওলানা আজাদ, কে এম মুন্সী, সি ভি রমন, মাদার তেরেসা, জয়প্রকাশ নারায়ণ। ইউনিয়ন কর্তারাই ঠিক করেন কাদের ছবি তাঁরা টাঙাবেন। কাদের ইউনিয়নের লাইফ মেম্বারশিপ দেবেন। ২ মে সম্মানিত করার কথা ছিল সাবেক উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারিকে। ছবি নিয়ে গোলমালে সেই অনুষ্ঠান বাতিল হয়।

এই যে ৮০টা বছর ধরে জিন্নাহর ছবি ওখানে রয়েছে, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন কিন্তু কখনো ওঠেনি। প্রশ্ন তোলেনি জনসংঘ। জন্মাবধি বিজেপিও। ছবিটা যে ওখানে রয়েছে, সেই কথাও প্রায় অজানাই ছিল! এপ্রিল মাসের শেষাশেষি প্রশ্নটা তোলেন আলিগড় থেকে লোকসভায় জেতা বিজেপির সতীশ কুমার গৌতম। এএমইউর উপাচার্য তারিক মনসুরকে চিঠি লিখে তিনি জানতে চান, ভারত ভাগের প্রবক্তার ছবি কোন যুক্তিতে শোভা পাচ্ছে এবং কেন তা সরানো হবে না? বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপাত্র শফি কিদোয়াই তাঁকে উত্তরে বলেন, জিন্নাহ ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কোর্টের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তাঁর ছবি রয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন ভবনে। সিদ্ধান্তটি ইউনিয়নের। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নয়। তা ছাড়া ছবিটাই শুধু আছে। জিন্নাহর স্মরণে কোনো অনুষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় না।

গোলমাল শুরু হয় মে মাসের শুরু থেকে। প্রায় ১০টি ‘হিন্দু সংগঠন’ একজোট হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে হানা দেয়। উদ্দেশ্য, জিন্নাহর ছবি টেনে নামিয়ে দেওয়া। শুরু হয় দুই তরফা মারধর। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। লাঠি চালায়। বেশ কয়েকজন আহত হন। জেলা প্রশাসন ইন্টারনেট যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কদিন ধরে থমথম করতে থাকে গোটা আলিগড়।

বিতর্কটা কিন্তু থেমে থাকল না। ছড়িয়ে পড়ল রাজ্যের অন্যত্র। যেমন আগ্রা। সেখানে একই দিনে পরপর দুটি ঘটনা ঘটে। প্রথমটা শহরের পূর্ত বিভাগের গেস্টহাউসে। সেখান থেকে উধাও হয়ে যায় আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমদ খানের ছবি। জেলা শাসক বলেন, গেস্টহাউসের মালিক রাজ্য সরকার। সেখানে কার ছবি থাকবে, না থাকবে, তা নির্ভর করে রাজ্য সরকারের মর্জির ওপর। তাঁর কিছু করার নেই।

দ্বিতীয় ঘটনাটা অন্য রকম। দেখা গেল, শহরের কোনায় কোনায় শৌচালয়ের দেয়ালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি লেপটানো। কাজটা শহরের দেব সমাজ কলেজের ছাত্রদের। তারা ‘হিন্দুত্ববাদী’ ও ‘জাতীয়তাবাদী’ দেশভক্ত। এক খবরের কাগজের সাংবাদিক লিখেছেন, ‘দেখি একজন জিন্নাহর একটা ছবি শৌচালয়ের ভেতরে দেয়ালে আঠা দিয়ে সাঁটছে। ছেলেটি কলেজপড়ুয়া। জিজ্ঞেস করতে বলল, দেশভাগের খলনায়কের প্রকৃত স্থান দেশের শৌচাগার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়।’

হিন্দুত্ববাদ বা জাত্যভিমানের জাগরণে ইদানীং পুরস্কারের বন্যা বইছে। পদ্মাবতী বিতর্কের সময়ও তা হয়েছিল। দীপিকা পাড়ুকোনকে ‘সূর্পনখা’ করার হাঁক উঠেছিল পঞ্চাশ লাখ! জিন্নাহ বাদ যাবেন কেন? একদল বলল, ছবি যে সরাবে, সে পাবে পাঁচ লাখ টাকা। আর একটা সংগঠন হুমকি দেয়, জিন্নাহর ছবি সরানো না হলে তারা আইন হাতে তুলে নেবে। অল ইন্ডিয়া মুসলিম মহাসংঘ নামে একটা অনামি সংগঠনকে বিজেপি ইদানীং পালন করছে। তাদের শীর্ষ নেতা বললেন, ভারত ভাগের খলনায়কের ছবি ভারতে রাখার কোনো মানেই হয় না। জিন্নাহর ছবি যে সরাবে, তার ইনাম এক লাখ টাকা।

হায় রে, দেশভাগের ইতিহাস এদের কাছে এতটাই সরল! হিন্দুত্ববাদীদের কাছে জিন্নাহই একমাত্র ‘ভিলেন অব দ্য পিস’, অথচ বিনায়ক দামোদর সাভারকর সেই ১৯২৩ সালে লেখা হিন্দুত্ব বইয়ে এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৩৭ সালে হিন্দু মহাসভার সম্মেলনে তাঁর ভাষণে দ্বিজাতিতত্ত্বের অবতারণা করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘দেয়ার আর টু নেশনস ইন দ্য মেন: দ্য হিন্দুজ অ্যান্ড দ্য মোসলেমস ইন ইন্ডিয়া। দ্য হিন্দুজ আর দ্য নেশন ইন ইন্ডিয়া-ইন হিন্দুস্তান, অ্যান্ড দ্য মোসলেম মাইনরিটি আ কমিউনিটি।’ ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, সাভারকরের ঘোষণা মুসলিম লীগের নজর এড়ায়নি। তারা বুঝেছিল, অখণ্ড ভারতে মুসলমানরা কখনো ন্যায়বিচার পেতে পারে না। জীবনের মাত্র শেষ ১৬ মাস যিনি ভারতে কাটাননি, দেশভাগের সেই একমাত্র ‘খলনায়ক’ জিন্নাহ ১৯১৬ সালে বালগঙ্গাধর তিলকের হয়ে দেশদ্রোহ মামলায় আদালতে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জিতেছিলেন। তাঁর ভূমিকার স্বীকৃতি রয়েছে বোম্বে হাইকোর্ট মিউজিয়ামে। গান্ধী ও আম্বেদকরের পাশে রয়েছে জিন্নাহরও ছবি। ওই মিউজিয়ামের উদ্বোধক ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। কোনো গোলমাল কিন্তু সেদিন হয়নি!

আলিগড় বা আগ্রায় তো বটেই, গোটা উত্তর প্রদেশে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রীকে দেখে অবশ্য তা বোঝার উপায় নেই। প্রত্যাশিতভাবেই তিনি নীরব। নীরব গুরুগ্রামের ঘটনা নিয়েও। গুরুগ্রাম, এই সেদিন পর্যন্ত যার নাম ছিল গুরগাঁও, তিন সপ্তাহ ধরে সেখানে উত্তেজনা জিইয়ে রয়েছে। স্থানীয় মুসলমানরা সেখানে সরকারি জমিতে ফি জুমায় নামাজ পড়ে আসছে। এত দিন কেউ বাধা দেয়নি। তিন সপ্তাহ আগের জুমাবারে প্রথম সেই বাধাটা এল।

এল ওই গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর কাছ থেকে। নামাজের সময় কয়েক শ ছেলে-ছোকরা বিভিন্ন স্থানে হাজির হয়ে বলল, প্রকাশ্যে ও সরকারি জমিতে নামাজ পড়া যাবে না। এভাবে অন্যদের অসুবিধা সৃষ্টি করা যাবে না। নামাজ পড়তে হলে মসজিদে যাও। ঈদগাহে যাও। সেই প্রথম জায়গায় জায়গায় শুক্রবারের নামাজ ভন্ডুল হয়ে যায়। দ্বিতীয় শুক্রবারেও বিক্ষোভ চলে। তৃতীয় শুক্রবারের আগে স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসন দুই সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে কিছু স্থান চিহ্নিত করে। যেখানে শতাধিক স্থানে নামাজ পড়া হতো, তৃতীয় শুক্রবার সেখানে জমায়েত হয় ৪৭টি জায়গায়। হিন্দুত্ববাদীদের দাবি, মসজিদ ও ঈদগাহ বাদ দিয়ে মাত্র সাত জায়গায় নামাজ পড়ার অনুমতি দিতে হবে। অন্যত্র নয়। তিন পক্ষে আলোচনা অব্যাহত।

হিন্দুত্ববাদীরা জোর পাচ্ছে সব দিক থেকে। প্রধানমন্ত্রী নীরব। দল নীরব। সরব শুধু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খাট্টার। তাঁর মুখে বিক্ষোভকারীদের সুরেরই প্রতিধ্বনি। তিনি বলেছেন, নামাজ পড়া হয় মসজিদে কিংবা ঈদগাহে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বাড়িতেও নামাজ পড়ে। রাস্তাঘাটে নামাজ পড়া হলে সাধারণ মানুষের অসুবিধা হতেই পারে। সাধারণ মানুষ আপত্তি জানালে তাকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। ৮০ বছর যে দাবি ওঠেনি, হঠাৎ আজ উঠছে কেন? যে গুরুগ্রাম তথ্যপ্রযুক্তির দৌলতে দেশের মানচিত্রে একটা স্বতন্ত্র জায়গা আদায় করে নিয়েছে, সেখানে হঠাৎ কেন এই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা?

এই মাসের ২৮ তারিখে উত্তর প্রদেশের কৈরানা লোকসভা ও নুরপুর বিধানসভার উপনির্বাচন। গোরক্ষপুর ও ফুলপুর লোকসভা উপনির্বাচনে অখিলেশ ও মায়াবতী হাত মিলিয়ে বিজেপির মোকাবিলা করেছে। কৈরানা ও নুরপুরেও তেমনই হতে চলেছে। সমাজবাদী ও বহুজন সমাজ পার্টি তো বটেই, বিজেপিকে হারাতে ওই ভোটে হাত মেলাচ্ছে রাষ্ট্রীয় লোক দলও। কংগ্রেসও সঙ্গী। জোট যদি ঠিকঠাক থাকে, এখন পর্যন্ত যে সম্ভাবনা যথেষ্টই ঝলমলে, বিজেপির কপাল তাহলে এবারও পুড়তে বাধ্য। লোকসভার সাধারণ নির্বাচনের আর দেরি নেই। যে রাজ্য বিজেপিকে ৮০-এর মধ্যে ৭১টি আসন দিয়েছিল, গোটা আর্যাবর্ত প্লাবিত হয়েছিল গৈরিক সুনামিতে, সেখানে ‘বুয়া-ভাতিজার’ হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খেতে কী করে তারা রাজি হয়? ২০১৯-এর সম্ভাব্য মুশকিল আসান তাই সংখ্যাগুরু মেরুকরণ।

জিন্নাহর ছবি কিংবা প্রকাশ্যে নামাজের বিরোধিতা তারই সলতে পাকানো। ভোট আসছে। মেরুকরণের রাজনীতিও প্রাসঙ্গিকতা পাচ্ছে।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি