ইরান চুক্তি বাঁচানোর উপায়

‘আমেরিকা ফার্স্ট’ (আগে আমেরিকার স্বার্থ) কথাটি যে নেহাতই কথার কথা নয়, ট্রাম্প যে এই কথা কাঁটায় কাঁটায় বিশ্বাস করেন, সে বিষয়ে এখন আর কোনো সন্দেহ রইল না।

ইরান চুক্তি থেকে সরে আসার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প সব মিত্রদেশের উপদেশ ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি খুবই স্থূলভাবে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ অন্য দেশগুলোর স্বার্থের প্রতি অসম্মান দেখিয়েছেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ট্রাম্পকে বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।

ট্রাম্প এর আগে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে এসেছেন। এখন ইরান চুক্তিকে ধ্বংস করছেন। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাঁর এই ধ্বংসোন্মাদনা যখন থামার কোনো লক্ষণ নেই, তখন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার দায়িত্ব আন্তর্জাতিক বিশ্বের ঘাড়েই বর্তায়।

এতে কোনো সন্দেহ নেই, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত তাঁর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে পুলকিত করেছে। বারাক ওবামার প্রধান অর্জনগুলো একের পর এক ধ্বংস করার সময় এই গোষ্ঠীর উল্লাস দেখা গেছে। কিন্তু ইরান চুক্তি শুধু ওবামার একলার অর্জন নয়। এটিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় সাফল্য হিসেবে দেখা হয়। প্রকৃতপক্ষে ইউরোপীয় ইউনিয়নই প্রথম বহু কাঠখড় পুড়িয়ে ইরানকে এই চুক্তিতে রাজি করিয়েছিল।

ট্রাম্প তাঁর নিজের সিদ্ধান্তের পক্ষে সাফাই দিয়ে টুইটারে বলেছেন, ‘মনে করে দেখুন, ইরান চুক্তির জোরে তেহরান কী ধরনের বাজে আচরণ করেছে। তারা মধ্যপ্রাচ্য নিজেদের কবজায় নেওয়ার জন্য যা যা দরকার, সব করতে চাইছে। কিন্তু এখন আর সেটি তারা করতে পারবে না!’

এটা ঠিক, ইরান মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার করছে। কিন্তু এটা ভাবাও ঠিক হবে না, ইরান চুক্তি ভেঙে দিলেই তারা সেখান থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেবে। বরং এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়া ইরানের কট্টরপন্থীদের আরও সাহসী করে তুলবে এবং ইরাক, সিরিয়া, লেবানন এবং আশপাশের এলাকায় তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে।

আরও ভয়ানক ব্যাপার হলো, ইরানকে পরমাণু কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার মতো বিকল্প প্রস্তাব দিতেও ট্রাম্পকে পিছপা হতে দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় ইউরোপীয় নেতাদের দৃশ্যপটে হাজির না হয়ে কোনো উপায় থাকছে না। ইরান চুক্তিতে ইইউ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা থেকে তাদের সরে আসা মোটেও উচিত হবে না।

বরং এই পরিস্থিতিকে সুযোগ হিসেবে লুফে নিয়ে তাদের ইরান ইস্যুতে আরও সম্প্রসারিত এমন একটি কৌশলনীতি গ্রহণ করতে হবে, যার মাধ্যমে ইরানের নেতারা তাঁদের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কার্যক্রম নিয়ে বিশ্বনেতাদের উদ্বেগকে আমল দেবেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাঁদের আচরণকে সংযত করবেন। এই চেষ্টা সফল হলে ইরান ইস্যুতে আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাবর্তনের পথ খুলে যাবে।

ইরান চুক্তি বাঁচাতে এবং নিজেদের কূটনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে ইইউ ইরানের সঙ্গে তার বিদ্যমান অর্থনৈতিক সম্পর্ক কাজে লাগাতে পারে। ইরানকে অবশ্যই বোঝাতে হবে, ইরান তার দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কার্যক্রম বন্ধ করা এবং মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার অনুকূল আচরণের মাধ্যমে ইউরোপের সঙ্গে তার ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে পারবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নকে স্পষ্ট ভাষায় ইরানকে বলতে হবে, তারা যদি আবার ইউরেনিয়াম–সমৃদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু করে, তাহলে ২০১৫ সালের
আগে তাদের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল, তা আবার বলবৎ করা হবে।

একই সঙ্গে তাদের ইরানকে এই আশ্বাসও দিতে হবে যে, ইরান যদি চুক্তির শর্ত মেনে চলে, তাহলে ইরানি কোম্পানিগুলোকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার হাত থেকে রক্ষা করা হবে। অবশ্য ইরানের জন্য এই ধরনের রক্ষাকবচ দেওয়া রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে খুবই ব্যয়বহুল হবে।

কিন্তু তা হলেও তা মেনে নেওয়া উচিত হবে। নইলে মধ্যপ্রাচ্যে পরমাণু প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে ট্রাম্পের হঠকারী সিদ্ধান্ত বিনা বাক্যে মেনে নিলে ইউরোপের জনগণ তাদের সরকারগুলোর ওপর খেপে যেতে পারে।

নতুন সম্প্রসারিত পরিকল্পনায় মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইরান, সৌদির নেতৃত্বাধীন সুন্নি দেশগুলো, ইসরায়েল, চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রকে যুক্ত করে তারা যাতে মধ্যপ্রাচ্যে প্রক্সি যুদ্ধ না চালায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

ট্রাম্পের ইরান চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে, ইউরোপের নিরাপত্তা ও অগ্রগতি কতখানি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়াই ইরান চুক্তিকে বাঁচিয়ে রাখা ইউরোপের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

গাই ফেরহোফ্স্টাড বেলজিয়ামের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টে অ্যালায়েন্স অব লিবারেলস অ্যান্ড ডেমোক্র্যাটস ফর ইউরোপ গ্রুপের সভাপতি