রমজানে অস্বাভাবিক বাজার

রমজান মাস শুরু হয়েছে এবং ব্যবসায়ী নেতাদের আশ্বাস মিথ্যা প্রমাণ করে প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বিভিন্ন মাত্রায় বেড়েছে। কিন্তু অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে এই মাত্রায় দাম বাড়ার যুক্তিসংগত কারণ নেই, কেননা বাজারে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ বিপুল। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হলে পণ্যের দাম বাড়ে, কিন্তু যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে, সেগুলোর কোনোটার সরবরাহে ঘাটতি আছে—এমন খবর পাওয়া যায়নি।

তাহলে এমন অস্বাভাবিক মাত্রায় দাম বাড়ার কারণগুলো কী হতে পারে?

প্রথমত, ব্যবসায়ীরা রমজান মাস উপলক্ষে বাড়তি মুনাফা করার লোভ সামলাতে পারছেন না। একটি উদাহরণ চিনি, যার চাহিদা রমজান মাসে বেশ বাড়ে। সব উৎস থেকে পাওয়া খবর হলো, দেশে এই মুহূর্তে চিনির মজুত আছে মোট চাহিদার তুলনায় বেশি, বাজারে সরবরাহেরও কোনো ঘাটতি নেই, উপরন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম কমেছে। কিন্তু দেশের খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চিনির দাম ৫ টাকা বেড়েছে। বোঝা যায়, ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়েছেন। যেমন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন রোজা উপলক্ষে গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে প্রতি কেজি ৪৫০ টাকা, কিন্তু খুচরা বিক্রেতারা তা বিক্রি করছেন ৫০০ টাকা দরে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার ফলে যেসব আমদানি পণ্যের দাম দেশের বাজারেও কমেছে, সেগুলোর খুচরা বিক্রেতারা দাম কমাননি। ভোজ্যতেল ও ছোলার ক্ষেত্রে এ রকম দেখা যাচ্ছে, দাম কমার সুফল পাচ্ছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা, ভোক্তারা নন। লবণ কোম্পানিগুলো খুচরা বিক্রেতাদের প্রতি কেজি লবণে ১০ টাকা কমিশন দিচ্ছে, ভোক্তা পর্যায়ে দাম কমাচ্ছে না। অর্থাৎ এসব ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ব্যবসায়ীদের ইচ্ছামাফিক।

দ্বিতীয়ত, কৃষিজাত খাদ্যপণ্যের দাম ভোক্তা পর্যায়ে দুই থেকে চার গুণ বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদক বা কৃষকের কোনো লাভ হচ্ছে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বগুড়া জেলার মহাস্থান হাটে কৃষক এক কেজি কাঁচা মরিচ বিক্রি করে পাচ্ছেন ২০ টাকা, সেই মরিচ মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে বগুড়া শহরের ফতেহ আলী বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা দরে। বেগুন, পটোল, ঝিঙে, ঢ্যাঁড়স, শসাসহ অন্যান্য সবজির দামেও এ রকম অস্বাভাবিক তারতম্য লক্ষ করা যাচ্ছে। উৎপাদনকারী বা কৃষক তাঁর উৎপাদিত ফসলের যে দাম পান, তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেন না; অনেক ক্ষেত্রে লাভ দূরে থাক, উৎপাদন খরচই ওঠে না। কিন্তু সেই একই কৃষিপণ্য ভোক্তাকে কিনতে হয় অনেক বেশি দামে—আমাদের দেশের বাজারব্যবস্থার এই অসংগতি প্রায় সারা বছরই লেগে থাকে। কিন্তু রমজান মাসে দেখা যাচ্ছে অসংগতিটা বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক মাত্রায়।

এর কি কোনো প্রতিকার নেই? কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বগুড়া জেলা মার্কেটিং কর্মকর্তার বক্তব্য হলো: ‘পাইকারি বাজারের সঙ্গে খুচরা বাজারের দামের পার্থক্য নিয়ে জেলা পর্যায়ের সভায় বহুবার আলোচনা হয়েছে। সবজির খুচরা বাজার নিয়ন্ত্রণের উপায় খোঁজা হচ্ছে।’ আমাদের বক্তব্য হলো, পাইকারি ও খুচরা বাজারে দামের অস্বাভাবিক পার্থক্য গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে রাখতে হলে এই অস্বাভাবিকতার কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে। সবজির পাইকারদের সংঘবদ্ধভাবে কৃষকদের ঠকানোর অভিযোগ বহুলালোচিত, কিন্তু খুচরা বাজারেও যে একধরনের সংঘবদ্ধ ‘পকেট কাটা’র অভিযোগ আছে, তা নিয়ে আলোচনা কম হয়। এটা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। তা ছাড়া, পণ্য পরিবহনের পথে বিভিন্ন পর্যায়ে যে চাঁদাবাজি চলে এবং রমজান মাসে যা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়, সেটা দমন করার প্রবল উদ্যোগ প্রয়োজন। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকজন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে। এসব বন্ধ করতে হবে।

সর্বোপরি বাজারের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে।