রোহিঙ্গা গণহত্যার বিরুদ্ধে শিল্প

শাহাবুদ্দিনের আঁকা ‘রোহিঙ্গা’ ছবিতেই রয়েছে একুশ শতকের এই সর্বশেষ গণহত্যার এক ধারাভাষ্য
শাহাবুদ্দিনের আঁকা ‘রোহিঙ্গা’ ছবিতেই রয়েছে একুশ শতকের এই সর্বশেষ গণহত্যার এক ধারাভাষ্য

পাবলো পিকাসো একসময় বলেছিলেন, শিল্পের কাজ বসার ঘরের শোভাবর্ধন নয়। শিল্প হলো যুদ্ধের হাতিয়ার। আমরা এই হাতিয়ার নিয়ে যুদ্ধে যাই। কথাটা সেই সময় বলা, যখন পিকাসো তাঁর ‘গের্নিকা’ ছবির নির্মাণ শেষ করেছেন। সেটি ছিল স্পেনের গের্নিকা শহরে ফ্রাঙ্কো বাহিনীর তাণ্ডবের বিরুদ্ধে 

তাঁর প্রবল প্রতিবাদ। অবরুদ্ধ প্যারিসে তাঁর স্টুডিওতে এসে সে ছবি দেখে এক জার্মান সৈন্য জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এটি কার কাজ?’ উত্তরে পিকাসো বলেছিলেন, ‘তোমাদের।’

ঢাকার কসমস বুকসের নতুন প্রকাশনা আর্ট অ্যাগেইনস্ট জেনোসাইড দেখার পর পিকাসোর সেই উত্তর নতুন করে মনে পড়ল। গ্রন্থটির বিষয় রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে ঘরবাড়ি-ভিটেমাটি ছেড়ে নিজের জীবন নিয়ে পালিয়ে আসা প্রায় আট লাখ মানুষের বেদনা ও বিক্ষোভের গল্প, শিল্পীর তুলিতে অথবা চিত্রগ্রাহকের ক্যামেরায় যা এখানে ধরা পড়েছে। প্রচ্ছদে শিল্পী শাহাবুদ্দিনের আঁকা ‘রোহিঙ্গা’ ছবিতেই রয়েছে একুশ শতকের এই সর্বশেষ গণহত্যার এক ধারাভাষ্য। হাজারো শব্দ ব্যবহার করেও যে বেদনা ও বঞ্চনার বাস্তবতা উদ্ধার করা সম্ভব নয়, শিল্পীর তুলিতে সেই আশ্চর্য নির্মাণ সম্ভব হয়েছে।

ছবিটির দিকে একবার ভালোভাবে তাকান। সর্বস্ব খুইয়ে হাজার নারী, পুরুষ, শিশু উন্মাদের মতো ছুটছে। অদূরে অগ্নিদগ্ধ গ্রামের দৃশ্য, গ্রাম নয়-যেন আগুনের কুণ্ডলী। কারও কাঁখে দুধের শিশু, কারও ঘাড়ে পুঁটলি, সামান্য যা কিছু বাঁচানো গেছে, তা-ই নিয়েই দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছে মানুষ। চোখের সামনে একটি নৌকা, আপাতত লক্ষ্য সেটি। আশা, এই নৌকা তাদের পৌঁছে দেবে সীমান্তের ওপারে, নিরাপদ আশ্রয়ে।

শাহাবুদ্দিনের আরও একটি ছবিতে রয়েছে এই নৌকার প্রতীকটি। না, ঠিক নৌকা নয়, নৌকার মাস্তুল। অন্য সবকিছু ছাপিয়ে এই মাস্তুলই চোখে পড়ে। নদীর উত্তাল ঢেউ, তার বুকে বিশাল মাস্তুল, সে নৌকার গলুই বা পাটাতন কিছুই নজরে আসে না। কুচকুচে কালো সে মাস্তুল দেখে ভয় জাগে, মনে হয় এক দানব। আবার তাকে দেখেই জাগে আশা। হ্যাঁ, দানবের মতো বিশাল, লোহার মতো শক্ত এই নৌকাই হয়তো ঠিক পৌঁছে দেবে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে।

অথবা একবার দেখে নিন সালাহউদ্দিন আহমেদের তোলা একটি ছবি, যেখানে নিজের বৃদ্ধা মাকে গোলপাতার ঝুড়িতে বসিয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে দুই ভাই। তাঁরই তোলা আরেকটি ছবিতে দেখি অসংখ্য ক্লান্ত, উদ্বিগ্ন ও সন্ত্রস্ত মানুষের মুখ। প্রত্যেকের হাত সামনে বাড়ানো, অদৃশ্য কোনো দাতার দিকে, যে হয়তো এক মুঠো চাল অথবা পানির একটি বোতল তুলে দেওয়ার জন্য এগিয়ে এসেছে। এসব মানুষের একসময় নিজস্ব বাসগৃহ ছিল, কর্মসংস্থান ছিল, শিশুদের ছিল স্কুল ও খেলার মাঠ। এখন সেসবের কিছুই নেই, আছে কেবল প্রতীক্ষা।

একই সঙ্গে বেদনার ও প্রতিবাদের ছবি। এই ছবি দেখে একদিকে আমরা আহত হই, কুঁকড়ে আসি মানবতার লাঞ্ছিত, অপমানিত মুখাবয়বটি দেখে। অন্যদিকে বুকের ভেতর আগুন জ্বলে ওঠে। যে সামরিক জান্তা এই পরিকল্পিত জাতিহত্যার জন্য দায়ী, তাদের প্রতি জন্মায় ঘৃণা। কী অপরাধ ছিল এই মানুষগুলোর? ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সদস্য বলেই কি তারা আক্রান্ত? গত ১০০ বছরে এই একই দৃশ্য আমাদের কতবার দেখতে হয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ৬০ লাখ ইহুদি নিহত হয়েছে, একাত্তরে ৩০ লাখ বাঙালি নিহত হয়েছে, নব্বইয়ের দশকে নিহত হয়েছে রুয়ান্ডার প্রায় এক লাখ তুতসি। সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল একুশ শতকের প্রথম প্রহরে।

প্রধানত চিত্রকলা ও ফটোগ্রাফি সমৃদ্ধ হলেও আর্ট অ্যাগেইনস্ট জেনোসাইড বস্তুত একুশ শতকের এই সর্বশেষ গণহত্যার একটি বিশ্লেষণী গ্রন্থ। দেশি-বিদেশি অনেকের প্রবন্ধ রয়েছে, সবার একমত, রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর প্রতি যে অপরাধ ঘটেছে-ঘটে চলেছে, তা এককথায় ‘টেক্সট বুক এথনিক ক্লিনজিং’ বা পরিষ্কার জাতিহত্যা। অধ্যাপক সি আর আবরারের একটি তথ্যমূলক প্রবন্ধে একদিকে রয়েছে এই সংকটের রাজনৈতিক চরিত্র, অন্যদিকে এটি কেন গণহত্যা, তার যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা। এই গণহত্যার সকল দায়ভার একা সেনাবাহিনীর নয়, মিয়ানমার সরকারের, সে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের,
এমনকি সে দেশের মানুষেরও। মানবাধিকার নেত্রী হিসেবে প্রশংসিত অং সান সু চিও দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।

দায়িত্ব এড়াতে পারে না আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীও। কোনো ভুল নেই, সেনাবাহিনীর সদস্যদের বন্দুকের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়েছে মানুষের বুক, তাদের হাতে ধরা দেশলাইয়ের আগুনে পুড়েছে নিরীহ গ্রাম। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেই বন্দুক অথবা দেশলাই এসেছে বিদেশ থেকে। এসব বিদেশির কেউ কেউ নিজেদের পরাশক্তি ভাবে, সেই যুক্তিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তারা ভেটো প্রদানের ক্ষমতাও রাখে। এদেরই কাঁধে বন্দুক রেখে জাতিহত্যায় মেতেছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। কথার কূটচালে তারা যত ব্যাখ্যাই দিক না কেন, নিজেদের হাতে লেগে থাকা রক্তের দাগ এই পরাশক্তিধর নেতারা কিছুতেই মুছতে পারবে না। নিহত ও আশ্রয়চ্যুত প্রতিটি রোহিঙ্গার অভিশাপ তাদেরই বহন করতে হবে।

যাকে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলি, তার প্রতিনিধি হলো জাতিসংঘ। এই বিশ্ব সংস্থার নিরাপত্তা পরিষদের দায়িত্ব ছিল অসহায় এই মানুষগুলোকে রক্ষা করা। সবচেয়ে ক্ষমতাধর যে পাঁচটি দেশ এই সংস্থার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, এবারও তারা ব্যর্থ হলো নিজেদের দায়িত্ব পালনে। ১৯৭১-এ ঠিক এই দৃশ্যের অভিনয়ই আমরা দেখেছি। একই ঘটনা ঘটে নব্বইয়ের দশকে বলকানে ও রুয়ান্ডায়। বস্তুত, মাত্র পাঁচটি শক্তিধর দেশের হাতে জিম্মি হয়ে আছে এই সংস্থা।

১৯৭১-এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো নয় মাস পরাশক্তিসমূহ নিজেদের কায়েমি স্বার্থ টিকিয়ে রাখার জন্য কথার কূটচাল চালিয়ে গেছে। ৩ ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরুর আগে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে একবারের জন্যও বৈঠকে মিলিত হতে পারেনি, পারে কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করতে। সেই একই ঘটনা ঘটে চলেছে রোহিঙ্গা প্রশ্নে। সুন্দর সুন্দর কথার কোনো কমতি নেই। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সংহতি জানাতে কক্সবাজার পর্যন্ত ছুটে এসেছেন। একজন কূটনীতিক এমন কথাও বলেছেন, উদ্বাস্তু শিশুদের কান্নার ধ্বনি এখনো তাঁর কানে বাজে। অথচ সবচেয়ে জরুরি যে কাজ, সমস্যা সমাধানে সুনির্দিষ্ট ও বলবৎযোগ্য একটি প্রস্তাব গ্রহণ, সেটি এখনো অধরাই রয়ে গেছে।

১৯৭১-এ নিরাপত্তা পরিষদের ব্যর্থতায় নিজের হতাশা ব্যক্ত করে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব মিয়ানমারের নাগরিক উ থান্ট মন্তব্য করেছিলেন, এই ঘটনা জাতিসংঘের মুখে কালিমা লেপে দিয়েছে। অনুমান করি, আজ বেঁচে থাকলে তিনি সম্ভবত সে কথারই পুনরাবৃত্তি করতেন।

বিশ্বের বৃহৎ শক্তিসমূহের এই ব্যর্থতার মুখে আর্ট অ্যাগেইনস্ট জেনোসাইড একটি সপাট চপেটাঘাত। শিল্পীরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, মানব ইতিহাসের এই সর্বশেষ গণহত্যা তাঁরা নীরবে মেনে নেবেন না। কসমস ফাউন্ডেশনের প্রধান এনায়েতুল্লাহ খান গ্রন্থের ভূমিকায় ঠিকই লিখেছেন, মানব প্রবৃত্তির সবচেয়ে বর্বর ও হীন প্রবণতার বিরুদ্ধে শিল্প এক প্রবল বিদ্রোহ। এই গ্রন্থ সে কথার প্রমাণ।

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি