একচক্ষু উন্নয়ন ও বামুনজি বিলপারে ভয়

জামালপুরের সুলতাননগর গ্রামের চারদিকে বামুনজি বিল। ছবি: লেখক
জামালপুরের সুলতাননগর গ্রামের চারদিকে বামুনজি বিল। ছবি: লেখক

গত এপ্রিলের শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু আরজুর আমন্ত্রণে হঠাৎ জামালপুর যাওয়া। ওর গ্রামের বাড়ি সুলতাননগরে যাওয়াও নিছক গ্রাম দেখতে। তবে সেখানে গিয়ে যেমন সুখী সুলতাননগরের ছবি দেখলাম, তেমনি দেখলাম মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের অশনিসংকেতে আতঙ্কিত এক জনগোষ্ঠীকে। দুর্যোগটি দানা বেঁধেছে আদর্শ বটতলা এলাকায় বিশেষ অর্থনৈতিক জোনে মাটি ভরানোকে ঘিরে। অভিযোগ উঠেছে, এই প্রকল্পের মাটি ভরানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বামুনজি বিল থেকে অপরিকল্পিতভাবে ১০ কোটি ঘনফুট মাটি তোলার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। অন্যদিকে, এই মাটি তোলার পরিকল্পনার কারণে ভাঙনের হুমকিতে পড়া আতঙ্কিত পাঁচ গ্রামের মানুষ এর বিরোধিতা করছে। কিন্তু সেই বিরোধিতা আটকাতে পারছে না ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটিকে। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় প্রশাসনের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি এই কাজ করছে।

জামালপুর শহর থেকে বেরিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা ভ্যানে করে প্রায় ৪৫ মিনিটে যাওয়া যায় সুলতাননগর গ্রামে। অসাধারণ সুন্দর এই গ্রামের চারদিকে বামুনজি বিল। পুরো গ্রামে সবুজের সমারোহ। দেশের সাম্প্রতিক এগিয়ে যাওয়ার প্রতিটি ইন্ডিকেটর বা নির্দেশক চোখে পড়ল সুলতাননগরে। গ্রামে ঢুকেই পেলাম নতুন ধানের গন্ধ। ধান কাটা-মাড়াই চলছে। বাতাসে তারই গন্ধ ম-ম করছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে পালা করা ধানের স্তূপ। কোথাও ধান সেদ্ধ হচ্ছে, কোথাও ধান শুকানো হচ্ছে। আবার কোথাও ধান মাড়াই হচ্ছে মেশিনে। কোথাও দেখলাম কুলায় করে ধান উড়ানো হচ্ছে পাতান থেকে ধান আলাদা করার জন্য। সবার মুখে হাসি। সবচেয়ে ব্যস্ত দেখলাম নারীদের। কেউ বসে নেই, কিছু না কিছু করছেনই। অথচ কৃষিতে এই নারীদের অবদানের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আমরা এখনো দিতে শিখিনি।

শেষ বিকেলে চলে গেলাম বামুনজি বিলের পাড়ে। বিলের ধারে ধানখেত। কোনো কোনো খেতে সবে ধান কাটা হয়েছে। মোথায় ভরা ন্যাড়া মাঠগুলো সেই সাক্ষ্য বহন করছে। অনেক খেতেই ধানগাছ ভরে আছে ধানে। পাকা ধানের সোনালি আভা আর সবুজ মিলে এক ঘোর লাগা রং তৈরি হয়েছে। নৌকায় করে লোকজন বিল পাড়ি দিচ্ছে। জাল দিয়ে মাছ ধরছে কিছু মানুষ। একদল হাঁস সারি বেঁধে রওনা দিয়েছে গৃহস্থের ঘরে ফিরবে বলে। সূর্যাস্ত উপভোগ করলাম বিলের ধারে। ক্লান্ত লাল সূর্য টুপ করে ডুবে গেল বিলের জলে লাল রঙের আভা তৈরি করে। বাংলাদেশের একটা পরিপূর্ণ সুখী গ্রামের চিত্র যেন সুলতাননগর। তখনো কিন্তু জানি না যে এই গ্রামের লোকজন আতঙ্কে আছে বিল রক্ষা নিয়ে।

যখন গ্রামের রাস্তা দিয়ে ঘুরছি, অনেক মুরুব্বি এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন, ‘তোমরা কারা বাবা? কোনখান থাইকা আইছ? সরকারি লোক নাকি?’ কেন সবাই আমাদের সরকারি লোক ভাবছে, তখন শুনলাম আরেক গল্প। সুলতানগরের সাম্প্রতিক দুঃখের গল্প। গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে আদর্শ বটতলায় সরকার পরিকল্পনা করেছে ‘ইকোনমিক জোন’ করার। এ জন্য ওই এলাকার জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়েছে। বিলসংলগ্ন ৯০ একর খাসজমি ইতিমধ্যেই প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ২২৭ একর বিলটির এখন অবশিষ্ট আছে ১৩৭ একর। গ্রামবাসীর এ নিয়েও তেমন কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু ঠিকাদার সংস্থা যেভাবে বিল থেকে মাটি তোলার পরিকল্পনা করছে, তাতে বামুনজি বিলের জীববৈচিত্র্যের বারোটা তো বাজবেই, এমনকি বিলের মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে পারে আশপাশের পাঁচটি গ্রামের ঘরবাড়ি আর জমিজমা। এক কিলোমিটার এলাকার কৃষকের কাঁচাপাকা ধানখেতের ওপর দিয়ে টানা হচ্ছে বড় বড় পাইপ। বসানো হচ্ছে ড্রেজারসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। গ্রামবাসীর চাওয়া জমি ভরাটের মাটি সংগ্রহ হোক অন্য কোথাও থেকে। এ নিয়ে তাঁরা জেলা প্রশাসকসহ অনেকের কাছেই স্মারকলিপি দিয়েছেন, কিন্তু কোনো ফল পাচ্ছেন না। এরপর আবেদন করেছেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে। তাতে স্থানীয় প্রতিমন্ত্রীও সুপারিশ করেছেন ঠিকাদার কর্তৃক অবৈধ মাটি উত্তোলন না করার জন্য। কেন বালু উত্তোলনকে অবৈধ বলছেন, তা জানতে চাইলে গ্রামবাসী বলছেন মূল প্রকল্পে মাটি বাইরে থেকে এনে ভরানোর কথা। সরকার সে জন্য বিশেষ বরাদ্দও রেখেছে। বেশি লাভের কৌশল হিসেবে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় বিল থেকে মাটি তোলার পরিকল্পনা করেছে। এখন গ্রামবাসীদের বড় চিন্তা নিজেদের গ্রামগুলোর আসন্ন বিপন্নতা। এক গ্রামবাসী বলছিলেন, ‘আমরা তো এখন ভালোই আছি। কৃষকদের গোলাভরা ধান আছে। কৃষিশ্রমিকেরা প্রতিদিন মজুরি পাচ্ছে ৫০০ টাকা। “বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা” হলে আমাদের নতুন আর কী সুবিধা হবে?’

দেশের এবং জামালপুর জেলার বৃহত্তর স্বার্থে তারপরও গ্রামবাসী এই প্রকল্পের বিরোধী নন। তাঁরা শুধু চান বিলের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। বিলের ওপর নানাভাবে নির্ভরশীল পাঁচ গ্রামের হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা, ঘরবাড়ি এবং জমিজমা যাতে কোনোভাবেই বিপর্যস্ত না হয়, সে জন্যই তাঁরা চান যেন বিল থেকে বালু তোলা না হয়। ভাবছিলাম, এ তো খুবই মৌলিক চাওয়া। গ্রামবাসীকে এটি চাইতে হবে কেন? যাঁরা উন্নয়ন পরিকল্পনা করেছেন, তাঁদেরও মূল ভাবনাতে এটি আছে। এ জন্যই মাটি বাইরে থেকে আনার বিশেষ বাজেট রাখা হয়েছে। তাহলে কেন এর ব্যতিক্রম হবে? ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের লাভের লোভ বড়, নাকি পাঁচটি গ্রামের অস্তিত্ব বড়? কবে যে স্থানীয় প্রশাসন এসব ব্যাপারে বৃহত্তর স্বার্থরক্ষায় স্বপ্রণোদিত হয়ে উদ্যোগ নেবে?

সন্ধ্যা গড়িয়ে যখন রাত হলো, পরিষ্কার আকাশে তখন বড় একটি চাঁদ উঁকি দিচ্ছিল। গ্রামের বাড়ির উঠানে আমাদের জন্য পাটি বিছিয়ে দেওয়া হলো। রাতের খাবার সেরে যখন শহরে ফেরার জন্য রওনা দিলাম, আমাদের মুখে তখনো লেগে আছে সুখী সুলতানগরের স্থানীয় রান্নার স্বাদ। ফেরার পথে দেখি বাজারে গ্রামবাসীর বড় জমায়েত হচ্ছে। সবাই একত্র হয়ে আলোচনা করছে, বিল রক্ষায় কী করা যায়। সমষ্টিগত এই প্রচেষ্টা দেখে ভালো লাগল। আশা করি, মাটি তোলাকে ঘিরে বড় বিরোধ সৃষ্টির আগেই প্রশাসনের বোধোদয় হবে। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় অন্ধকার কেটে যাবে। মনুষ্যসৃষ্ট দুঃখের শিকার হতে হবে না সুলতাননগরবাসীকে। সুখী সুলতাননগরের সবাই সুখেই থাকবে সবাই মিলে। এ চাওয়া কি খুবই অসম্ভব চাওয়া?

আনোয়ারুল হক: একটি বেসরকারি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত।

(প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজের)।