গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে ফেলা হচ্ছে

কর্ণাটকে সরকার গঠনের জন্য যে আসন দরকার, তার চেয়ে বেশি পাওয়ার পরও রাজ্যপাল বাজুভাই বালা বিরোধী জোটকে সরকার গঠন করতে দেননি। সরকার গঠনে তিনি অনুমতি দিয়েছেন বিজেপিকে। এই নিয়ে সম্প্রতি তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে। সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে গিয়ে কীভাবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে, সেই প্রশ্ন এখন সামনে দেখা দিচ্ছে।

যেকোনো গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী সরকারি প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার, যারা রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করবে।

কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে গত চার বছরে প্রতিটি অমূল্য প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে পড়েছে। বিজেপির হিন্দুত্ববাদী সরকার তাদের কর্তৃত্ব সম্প্রসারণ করতে এসব প্রতিষ্ঠানকে কবজায় নিচ্ছে।

রাজ্যপালদের নিজেদের পক্ষে টেনে (২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনে জেতার পর বিজেপি সব রাজ্যপালকে পদত্যাগ করতে বলেছিল, যাতে সেই পদে নিজেদের লোক বসানো যায়) নেওয়ার পর এখন বিচারব্যবস্থা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে সরকার। গত জানুয়ারি থেকে এই লক্ষণ স্পষ্ট হয়েছে। ওই মাসে সুপ্রিম কোর্টের চারজন শীর্ষস্থানীয় বিচারপতি এক নজিরবিহীন সংবাদ সম্মেলন করে প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের মামলা বণ্টনের সমালোচনা করেন। তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী, দীপক মিশ্র বেছে বেছে একেকটি মামলা তাঁর পছন্দের বিচারকদের কাছে পাঠান, যাতে রায় সরকারের অনুকূলে যায়।

এর তিন মাস পর কয়েকটি বিরোধী দল দীপক মিশ্রকে অভিশংসনের জন্য রাজ্যসভায় প্রস্তাব তোলে। রাজ্যসভার চেয়ারম্যান ও উপরাষ্ট্রপতি ভেঙ্কাইয়া নাইডু এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর দুজন এমপি সুপ্রিম কোর্টকে নাইডুর এই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করার জন্য আবেদন জানান। কিন্তু দীপক মিশ্র সেই দুজন এমপির আবেদনের শুনানি গ্রহণ করতে এমন একটি বেঞ্চ ঠিক করে দেন, যাঁরা দৃশ্যত তাঁর পক্ষেরই বিচারক। শেষ পর্যন্ত যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। মিশ্রর ঠিক করে দেওয়া বেঞ্চ সেই দুই এমপিকে দিয়ে তাঁদের আবেদন প্রত্যাহার করিয়ে নিয়েছেন। মিশ্র হয়তো নিরাপদে আছেন। কিন্তু এর মাধ্যমে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি যে ধাক্কা খেয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা খুব সহজ হবে না।

নির্বাচন কমিশনে (ইসি) বেশির ভাগ কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয় অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের মধ্য থেকে। তাঁদের নির্ধারিত মেয়াদে নিয়োগ করা হয়। তারপরও স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কয়েক দশক ধরে ভারতের ইসির সুনাম ছিল। কিন্তু গত বছর ইসির সেই উজ্জ্বল ভাবমূর্তিতে প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে। রীতি লঙ্ঘন করে বিজেপির নিয়োগ করা ইসির তৎকালীন প্রধান অচল কুমার জ্যোতি হিমাচল প্রদেশ ও গুজরাটের নির্বাচনের তারিখ ১৩ দিন আগে-পিছে করে দেন। অথচ এই দুই রাজ্যে একই দিনে নির্বাচন হওয়ার রেওয়াজ বহু বছর থেকে।

ইসির দাবি, গুজরাটে বন্যা-পরবর্তী ত্রাণকাজ বাধাগ্রস্ত যাতে না হয়, সে জন্য নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ভারতীয় বিশ্বাস করে, নিজেদের সুবিধার জন্য গুজরাটের নির্বাচন যতটা পেছানো যায়, তার জন্য বিজেপি ইসিকে চাপ দিয়েছে। ইসিও সেইমতো কাজ করেছে। এ ঘটনার পর সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তারাও সিইসির তীব্র সমালোচনা করেছেন।

ইসি গত জানুয়ারিতে একটি পদ্ধতিগত কারণ দেখিয়ে দিল্লি আইনসভার আম আদমি পার্টির ২০ জন সদস্যকে অযোগ্য ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়ে আরও খারাপ নজির সৃষ্টি করেছে। ওই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে আবার নির্বাচন হতো। এর প্রধান সুবিধাভোগী হতো বিজেপি। সেসব আসনে তাদের নতুন সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দিল্লি হাইকোর্ট এটিকে ‘খারাপ আইন’ আখ্যায়িত করে ইসির সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেন। কিন্তু ততক্ষণে ইসির ভাবমূর্তি যতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে।

ভারতের কলুষিত সরকারি প্রতিষ্ঠানের তালিকায় চলে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’ (আরবিআই)। ২০১৬ সালের নভেম্বরে ৫০০ ও এক হাজার টাকার নোট প্রত্যাহার প্রক্রিয়া চরম বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি করে। এই ঘোষণা দেওয়ার পর আরবিআই তাঁর আস্থা ধরে রাখতে পারেনি। এটা একেবারেই স্পষ্ট যে বিজেপির নোট বাতিলের এই সিদ্ধান্ত আরবিআইকে আগে থেকে জানানো হয়নি। এর কী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, সে বিষয়েও সে পূর্ব ধারণা নিতে পারেনি। ৭০ দিনের মধ্যে শুধু নোট প্রত্যাহার নিয়ে ১৩৮টি নোটিফিকেশন দিয়েছে আরবিআই। নোটিশগুলোর ভাষা দেখেই বোঝা যায়, আরবিআই বিজেপি সরকারের হাতের পুতুল হয়ে গেছে। সরকারের স্বার্থ হাসিলের জন্য যখন যে নির্দেশ দেওয়া দরকার, সে তা–ই দিচ্ছে।

গত বছরের জানুয়ারিতে ‘ইউনাইটেড ফোরাম অব রিজার্ভ ব্যাংক অফিসার্স অ্যান্ড এমপ্লয়িজ’ সরকারের কাছে লেখা চিঠিতে বলেছে, কারিগরি অপব্যবস্থাপনার কারণে আরবিআইয়ের স্বায়ত্তশাসন শেষ হয়ে গেছে। আরবিআইয়ের গভর্নর উরজিৎ প্যাটেল চুপ মেরে থাকতে থাকতে একেবারে ভেড়া বনে গেছেন। তাঁর এই চুপ থাকা গোটা প্রতিষ্ঠানটাকেই গিলে ফেলতে সহায়তা করছে।

ঠিক একইভাবে প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও রাজনৈতিকীকরণ করে ফেলছে মোদির সরকার। লে. জে. বিপিন রাওয়াতকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করতে গিয়ে সরকার রাওয়াতের চেয়ে জ্যেষ্ঠ দুজন কর্মকর্তাকে এড়িয়ে গেছে। রাজনৈতিক প্রপাগান্ডায় ব্যবহার করার জন্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মতো গোপনীয় সামরিক অভিযানের খুঁটিনাটি এই সরকার প্রকাশ করেছে।

দিল্লি পুলিশ এবং সিবিআই—এদের কেউই বিজেপির রাজনীতির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। যে সিবিআইকে একসময় অপরাধ দমনের স্বর্ণালি বাহিনী বলা হতো, এখন তারা ‘খাঁচায় পোরা তোতা পাখি’।

এই রকমের অসংখ্য স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান সরকারের মুঠোর মধ্যে চলে যাচ্ছে। এতে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে যার, তার নাম ‘গণতন্ত্র’।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

শশী থারুর: ভারতের কংগ্রেস পার্টির নেতা ও দেশটির সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী