কর্ণাটকি কুনাট্য রঙ্গ

কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনে নিরাপত্তাকর্মীদের তৎপরতা
কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনে নিরাপত্তাকর্মীদের তৎপরতা

হপ্তাখানেক ধরে কর্ণাটকে যা চলল, তাকে কুনাট্য ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। ভাগ্যিস কংগ্রেস মাঝরাতে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল, ভাগ্যিস সুপ্রিম কোর্ট গুরুত্ব অনুধাবন করে এগিয়ে এসেছিলেন, ভাগ্যিস শক্তি পরীক্ষার জন্য একটা দিনও বাড়তি সময় দিতে সুপ্রিম কোর্ট রাজি হননি, ভারতীয় গণতন্ত্রের আবরু তাই নির্লজ্জ বেহায়াদের হাত থেকে কিছুটা রক্ষা পেল। আমার চোখে কর্ণাটকি কুনাট্যের আসল নায়ক সুপ্রিম কোর্টই। যেদিন বিধানসভা ভোটের ফল বেরোল, সেই দিন থেকে দেশটা পরিষ্কার দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেল। বিজেপির তরি তীরে এসে ডুবল। তাদের ঠেকাতে কংগ্রেস ও ধর্মনিরপেক্ষ জনতা দল (জেডিএস) হাত-ধরাধরি করে ফেলল। বিধানসভায় এই দুইয়ের মিলিত শক্তি বিজেপির তুলনায় বেশি তো হলোই, সরকার গঠনের ‘ম্যাজিক ফিগারও’ ছুঁয়ে ফেলল। অথচ রাজ্যপাল, যাঁর ৮০ বছর বয়স, যিনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের আদর্শে লালিত-পালিত এবং উজ্জীবিত, সংঘের বাইরে আর কোনো কিছুই যাঁর কাছে দৃশ্যমান নয়, তিনি সরকার গড়তে ডেকে নিলেন বিজেপিকে। এই নির্লজ্জ দলবাজি ঠিক না ভুল, সেই বিতর্কেও দেশ ভাগ হয়ে গেল দুই শিবিরে। সৌভাগ্য এটাই যে ঠিক সময়ে সুপ্রিম কোর্ট ঠিক সিদ্ধান্তটা নিয়ে নেন। না হলে এই লজ্জা ঢাকা কঠিন হয়ে দাঁড়াত।

কুনাট্যের আরও অনেক কিছু বাকি ছিল। সরকার গড়তে প্রয়োজন যেখানে ১১২, বিজেপি সেখানে ১০৪-এ থমকে। বাকি থাকে চটজলদি জোট করে ফেলা দুই দলের ১১৬ এবং দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী, যাঁরা আবার জোটের দিকে ঢলে পড়েছিলেন। ভাত ছড়িয়ে কাক জড়ো করার মতো টাকা ছড়িয়ে এমএলএ কেনা ছাড়া আর কোনো উপায় না থাকলেও বিজেপির মহারথীরা ওই রাস্তায় হাঁটলেন। বিস্ময় জাগল, নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরাও কেন ওই বহু প্রাচীন চেনা খেলায় গা ভাসালেন! কেনই-বা তাঁরা দিল্লিতে দলের প্রাসাদোপম নতুন ভবনে বিজয় উৎসব পালন করলেন! কেন এমন ভাব দেখালেন যে তুড়ি মেরে ম্যাজিক ফিগারে পৌঁছে ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’ গড়ার কাজে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবেন? এ কথা কেন ভেবে দেখলেন না, এভাবে সরকার গড়লে মুখ পুড়বে নরেন্দ্র মোদিরই, যিনি দুর্নীতিমুক্ত ভারত গড়ার হাঁক দিয়ে দেশের মন জিতেছিলেন? কুনাট্যের খলনায়ক যদি হন রাজ্যপাল বাজুভাই বালা, পরিচালক তাহলে অবশ্যই মোদি-শাহ জুটি।
বিরোধীরা ভাবতেই পারে, বিশেষ করে কংগ্রেস, ভাগ্যিস বিজেপি একসঙ্গে এতগুলো ভুল করেছিল, না হলে প্রাসঙ্গিকতা পেতে অপেক্ষায় থাকতে হতো বছরের শেষে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের ভোট পর্যন্ত। সন্দেহ নেই, কর্ণাটকে বিজেপিকে রুখে দিতে পারা কংগ্রেসের কাছে মৃতসঞ্জীবনী সুধার কাজ করেছে। গোয়া, মণিপুর বা মেঘালয়ে রাহুল গান্ধী কিন্তু এই তৎপরতা দেখাননি। যুদ্ধে না নেমেই ওই তিন রাজ্যে তাঁর দল হার মেনে নিয়েছিল। অথচ তিন জায়গাতেই সংখ্যার দিক থেকে কংগ্রেস ছিল বিজেপির চেয়ে এগিয়ে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে কর্ণাটকে কংগ্রেসের তৎপরতা ছিল বিদ্যুৎগতির। ফলের গতিপ্রকৃতি স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সোনিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসেন রাহুল। ঠিক তখনই সোনিয়াকে ফোন করেন বিএসপি নেত্রী মায়াবতী। জেডিএসের সঙ্গে জোট বেঁধে তাঁর একজন বিধায়ক জয়ী হয়েছেন। বিজেপিকে ঠেকাতে সোনিয়াকে মায়াবতী বলেন জেডিএসের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসতে। রাহুলও বলেন একই কথা। সম্মত হন সোনিয়াও। বেঙ্গালুরুতে আগে থেকেই ঘাঁটি গাড়া গুলাম নবি আজাদ, মল্লিকার্জুন খারগে ও অশোক গেহলটকে বলা হয় কুমারস্বামীকে মুখ্যমন্ত্রী মেনে নিয়ে সমর্থনের নিঃশর্ত চিঠি কালক্ষেপ না করে রাজ্যপালের কাছে পাঠিয়ে দিতে। সেই চিঠি পৌঁছানোর অনেক পর সরকার গঠনের দাবি জানান ইয়েদুরাপ্পা। ততক্ষণে ভাগাভাগি চূড়ান্ত। বাড়তি একজনও নেই যাঁকে টানলে বিজেপির আসনসংখ্যা ইলাস্টিকের মতো বাড়তে পারে।

কর্ণাটক হাতছাড়া না করতে কংগ্রেস যা করল, বহুকাল তা কিন্তু তারা করেনি। প্রথমত, বিন্দুমাত্র দাবিদাওয়া করেনি। না চাইতেই মুখ্যমন্ত্রিত্বের পদ তারা জেডিএসকে ছেড়ে দিয়েছে। এর ফলে বিভিন্ন রাজ্যের শক্তিধর দলের কাছে রাহুল এই বার্তা পৌঁছে দিলেন যে বিজেপিকে রুখতে তাঁর দল স্বার্থত্যাগে প্রস্তুত। এই বার্তা কংগ্রেস সম্পর্কে অন্যদের ভীতি কাটাতে যেমন সাহায্য করবে, তেমনি প্রশস্ত করবে বিজেপিবিরোধী জোট গঠনের রাস্তা। রাজনীতিক হিসেবে রাহুলও যে বিচক্ষণ হয়ে উঠছেন, তিনি যে আগের তুলনায় এখন অনেক ‘পরিপক্ব’, অনেক ‘সিরিয়াস’, প্রমাণ রাখলেন তারও। বৃষ্টির ছোঁয়ায় মাচানের লাউডগার লকলকিয়ে ওঠার মতো কর্ণাটকি কুনাট্য কংগ্রেসকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। কংগ্রেসিদের এমন চনমনে অনেক দিন দেখা যায়নি।

তবে বিজেপি ছাড়াও রাহুলের কাছে অন্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চ্যালেঞ্জটা জোট-নেতৃত্বের। পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তেলেঙ্গানার চন্দ্রশেখর রাও কিংবা মহারাষ্ট্রের শারদ পাওয়ার বিজেপির বিরুদ্ধে সম্ভাব্য জোটের নেতৃত্বে রাহুলকে মানতে নারাজ। মমতা তো ‘বাঙালি প্রধানমন্ত্রী’ দেখার আগ্রহের কথা প্রায় সরাসরি প্রকাশও করে ফেলেছেন। কর্ণাটকের ফল বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি কংগ্রেসের সমালোচনা করে বলে দেন, জেডিএসের সঙ্গে জোট বাঁধলে বিজেপি উড়ে যেত। চন্দ্রশেখর রাও-ও মমতার ভাবনার শরিক। শারদ পাওয়ারের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্ক অনেকটা স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার মতো। ইন্দিরা আমলে দল ছাড়লেন। তারপর ফিরে এলেন। সোনিয়ার বিদেশিনী পরিচয় নিয়ে আপত্তি তুলে ফের দল ছাড়লেন। আবার কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধলেন। মহারাষ্ট্রে জোট ভাঙতে ভাঙতেও টিকে রয়েছে। বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেসকে সঙ্গ দিচ্ছেন। কিন্তু সে ছিল সোনিয়ার কংগ্রেস। ‘হাঁটুর বয়সী’ রাহুলকে জোটের নেতা মানতে তাঁরও বাধো বাধো ঠেকছে। এই আড়ষ্টতা ও কিন্তু কিন্তু ভাব কাটাতে হলে কংগ্রেসের প্রয়োজন রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড় বিজেপির হাত থেকে মুক্ত করা এবং যে রাজ্যে অন্যরা শক্তিশালী, সেখানে তাদের ময়দান ছেড়ে দেওয়া। কর্ণাটকে সেই নমনীয়তা রাহুল দেখাতে পেরেছেন। এটা তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে সহায়ক হতে পারে।

কর্ণাটকের কুনাট্য আগে বহুবার মঞ্চস্থ হয়েছে। আগামী দিনেও হবে। হয়েছে ও হবে বলতে পারছি এই কারণে যে ত্রিশঙ্কু সংসদ বা বিধানসভায় রাষ্ট্রপতি অথবা রাজ্যপাল কাকে সরকার গড়তে ডাকবেন, ভারতীয় সংবিধানে তা নির্দিষ্টভাবে বলা নেই। ৭০ বছর আগে যাঁরা সংবিধান রচনা করেছিলেন, তাঁদের মূল্যবোধ ছিল অন্য ধরনের। সে সময় তাঁদের কাছে রাজনীতির অর্থ ছিল দেশসেবা। তাঁরা তখন ভাবতেও পারেননি ৭০ বছর পর মূল্যবোধ এভাবে বিসর্জিত হবে। রাজনীতি হয়ে উঠবে দলসর্বস্ব ও সর্বগ্রাসী। ভারতীয় সংবিধান শতাধিকবার সংশোধন হয়েছে প্রয়োজনের খাতিরে। কর্ণাটক কুনাট্যের পর সেই প্রয়োজন আরও বেশি করে অনুভূত হচ্ছে। রাষ্ট্রপতি অথবা রাজ্যপালেরা কোন পরিস্থিতিতে সরকার গড়তে কাকে ডাকবেন, বিশেষ করে ত্রিশঙ্কু সংসদ অথবা বিধানসভায়, গণতন্ত্রের স্বার্থে সেই নীতিমালা স্পষ্ট করে তৈরি করার সময় এসেছে। না হলে ভবিষ্যতের বাজুভাই বালারা যা ইচ্ছা তা-ই করে যাবেন। ক্ষুব্ধ ও বঞ্চিতদেরও মাঝরাতে সুপ্রিম কোর্টের দরজায় কড়া নাড়তে হবে।

মুখ পোড়ার পর বাজুভাই বালা এখন কী করবেন? প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আসার পর থেকেই। তিনি কি পদত্যাগ করবেন? মোদি-শাহ জুটি কি তাঁকে সরিয়ে দেবে? কঠিন প্রশ্ন। উত্তরও অজানা। কুনাট্যের যবনিকা পতনের পর এই আগ্রহটা জেগে থাকছে।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি