রোহিঙ্গা: কিসের আশায় অপেক্ষা?

রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। ফাইল ছবি
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। ফাইল ছবি

যে হরিণের একটি চোখ, তার বড় সমস্যা—তাকে বাঘ বা কুমিরের মধ্যে বেছে নিতে হয়, কে তার জল্লাদ হবে? বাঁচার কথা ভুলে কম কষ্টের মৃত্যু নিয়ে তাকে দরাদরি বা দৌড়াদৌড়ি করতে হয় এন্তার। দরাদরি নিশ্চয় দৌড়াদৌড়ির সমার্থক বা উচিত বিকল্প নয়, কিন্তু দরাদরির জন্য মাঝেমধ্যে দৌড়াদৌড়ি জরুরি হলেও দরাদরি কখনোই দৌড়াদৌড়ি বা ছুটোছুটিসর্বস্ব শরীরচর্চা নয়।

যেহেতু দৌড়াদৌড়িটা দৃশ্যমান থাকে, তাই মানুষের নজরে সেটায় ধরা পড়ে। দরাদরির অগ্রগতি দেখা যায় ফসলে, ধানে চাল আছে না চিটা আছে, তা ধান না দেখলে টের পাওয়া কঠিন। তবে এক চোখের হরিণের অঙ্ক ভিন্ন তার হিসাব-নিকাশও আলাদা। তাকে একবার নদীর দিকে ছুটতে হয়, যাতে বেঘোরে বাঘের হাতে প্রাণ না যায়। আবার নদীর কুমিরের লালসা থেকে বাঁচার জন্য বনের দিকে পালাতে হয়। ছোটাছুটির ওপরেই তাকে থাকতে হয়। তবে তার এই জান-কবুল ছোটাছুটি দেখে জহুরি শিকারির মনে হতে পারে, হরিণটা চঞ্চল, কর্মঠ, সুস্থ। তার মাংস উপাদেয় না হয়ে যায় না। এক চোখের হরিণের বিপদের কোনো ইয়ত্তা নেই; বাঁচার কোনো সুযোগও নেই। হয় কুমির না হয় বাঘ অথবা তির-বন্দুকের মালিক শিকারি কেউ না কেউ তাকে বধ করবেই করবে। সবাই এই সত্যটা জানলেও হরিণ কি তা জানে? আমরা কি জানি, আমাদের দৌড় কত দূর? আমাদের মঞ্জিলে মকসুদটা কী?

সবচেয়ে ভালো হতো, সব শরণার্থী যদি ঈদের নামাজ মিয়ানমারে তাঁদের দেশের বাড়ির ঈদগাহে গিয়ে পড়তে পারতেন, কিন্তু সেটা কি কখনো সম্ভব? কত ঈদ আসবে-যাবে, তা কি কারও জানা আছে? তবে আমরা জানি, ১৯৯১ সালের শরণার্থীরা এখনো আছেন, সবাই ফেরত যাননি। একাত্তরে আমাদের সঙ্গে ভারতে যাওয়া সবাই শেষ পর্যন্ত আসেনি—দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পরও না। না ফেরাদের একজন তো এখন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী।

মিয়ানমারের টালবাহানা আর আঞ্চলিক মুরব্বিদের স্বার্থের বাস্তবতা থেকে আমরা যদি কোনো সবক না নিই, তাহলে যে সবাই আমাদের নিতান্তই মেষশাবক ভাববে, তাতে কি কোনো সন্দেহ আছে? পর্বতের মূষিক প্রসব দেখতে দেখতে যদি এখনো আমরা ক্লান্ত না হই, তবে কবে?

মিয়ানমার সব সময় বলেছে, তারা বাংলাদেশে চলে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে। এ ব্যাপারে গত নভেম্বরে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছে; কিন্তু প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়া যে তিমিরে ছিল, সে তিমিরেই গড়াগড়ি খাচ্ছে, এগোচ্ছে না। দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবের নেতৃত্বে গঠিত যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ এ নিয়ে নাকি রাত-দিন বিরতিহীন কাজ করছে। এই গ্রুপের প্রথম বৈঠক হয় জানুয়ারিতে নেপিডোতে, আর দ্বিতীয় বৈঠক হয়েছে গত বৃহস্পতিবার ঢাকায়। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো অগ্রগতি নেই। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে অস্পষ্টতা থেকেই যাচ্ছে। হালকার মধ্যে ঝাপসা দেখলে বাস্তবতা হারিয়ে যায়।

তাহলে উপায় কী?

কফি আনানের সুপারিশ আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাবের বাইরে অন্য কোনো চূড়ান্ত সমাধান নিয়ে চিন্তা বা অন্য কোনো পথ খুঁজতে যাওয়ার কোনো মানে হয় না; স্থায়ী সমাধানের আর কোনো সহজ পথ খোলাও নেই। তবে অন্তর্বর্তীকালীন কতিপয় বিকল্প নিয়ে আমাদের চিন্তা আর চেষ্টা করা প্রয়োজন। এসব চিন্তার লক্ষ্য হবে—

ক. শরণার্থীরা যত দিন থাকবেন, যেন নিরাপদ আর পরিবেশবান্ধব পরিস্থিতিতে থাকেন।
খ. যত দ্রুত সম্ভব শরণার্থীরা সবাই ফিরে যাবেন।

শুধু যে আমরা শরণার্থীদের দ্রুত প্রত্যাগমন চাই—তা নয়, শরণার্থীরাও কেউ দয়ার জীবন চান না। তাঁরও ফিরতে চান। এখন পর্যন্ত আমরা ভাবছি, ফেরার বন্দর একটাই—মিয়ানমার! আমরা যখন জানি মিয়ানমার কোনো অবস্থাতেই সবাইকে ফেরত নেবে না, সবাই সেখানে যাবেও না, যেতে পারবেও না, তখন আমরা কেন বিকল্পের কথা ভাবব না? যাদের নেবে না বা যারা যেতে পারবে না, তাদের কী হবে?

তারা কি ৯১-এর শরণার্থীদের মতো থেকে যাবে বনভূমির নানা আন্তর্জাতিক বা জাতিসংঘের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শিবিরে? কিংবা গ্রামের বাইরে গড়ে ওঠা ঝুপড়িতে কিংবা নতুন পুরোনো আত্মীয়দের ঘর-বারান্দায়-হেঁশেলে?

পরিবার পুনর্মিলন কর্মসূচি একটা সম্ভাব্য বিকল্প হতে পারে। চলে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকেরই স্বামী, বাবা, মা, ছেলে, ভাই, নানা, দাদা অভিবাসী কর্মী অথবা আশ্রিত বাস্তুচ্যুত হিসেবে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আমিরাত, সৌদি আরবসহ পৃথিবীর নানা দেশে কর্মরত আছেন। ফেরত অভিবাসী বা আটকে যাওয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাঁদের পরিবারের মিলিত হওয়ার অধিকার এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার। রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো এসব দেশ ইচ্ছা করলেই সেসব দেশে কর্মরত রোহিঙ্গারা তাঁদের পরিবারকে নিয়ে যাতে পারেন। এই বিষয়টা কি আমাদের বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনায় তুলতে পারি না? ইসলামিক সম্মেলনের এজেন্ডাতে এটা রাখি না কেন?

তৃতীয় দেশে প্রত্যাবাসনের বিষয়টিও ভেবে দেখা প্রয়োজন; ভুটান থেকে বিতাড়িত নেপালি বংশোদ্ভূতদের নেপাল গ্রহণ করেনি। তারা ভুটানেও ফেরত যায়নি, ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকার নানা দেশ তাদের নাগরিকত্ব দিয়েছে। ভিয়েতনামে মার্কিনদের পরাজয়ের পর যেসব ভিয়েতনামি নৌকায় ভাসতে ভাসতে হংকং বা অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভিয়েতনামে ফেরত না পাঠিয়ে মার্কিন মুলুকে ঠাঁই দেওয়া হয়েছিল। রোহিঙ্গাদের জন্য সেই দরজা কেন বন্ধ থাকবে?

দেশের ভেতরে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে রাখার জন্য তাদের ‘দ্বীপান্তরে’ ভাসানচরে আর পাহাড় কেটে কম ঝুঁকির সমতল বানিয়ে পুনর্বাসনের কাজ এগিয়ে চলেছে; এখানেও সমাজভিত্তিক বিকল্প নিবাসের কথা ভাবা যায়। বনভূমি বা পাহাড়ে না রেখে তাদের গ্রামেই ইচ্ছুক পরিবারের সঙ্গে সংযুক্ত নিবাসে রাখার ব্যবস্থা আর্থিক ও সামাজিক সাশ্রয়ী হবে। সামাজিক নিরাপত্তার দিক থেকেও এই ব্যবস্থা অধিক যুক্তিপূর্ণ।

যেটাই করি না কেন, শরণার্থীদের কাজ দিতে হবে তাদের বসিয়ে রাখা কারোর জন্যই ভালো হচ্ছে না। হাওরে, নাটোরে, কিশোরগঞ্জে মানুষের অভাবে ধান কাটা যাচ্ছে না, আর হাজার হাজার মানুষ বেকার বসে আছে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার টিকিট হাতে? এটা কোনো মগজে মেনে নেবে?

দৌড়াদৌড়ির কথা উঠলেই আমার সুন্দরবনের শতাব্দী মণ্ডলের কথা মনে পড়ে—নাম শুনে তাঁর ধর্ম কী, সেটা আঁচ-অনুমান করা মুশকিল; লালন যেমন। চাঁদপাই রেঞ্জে তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা সত্তর দশকের শেষে। তবে ঘটনাটা আরও পরের। সেবার আমরা তাঁর নৌকায় শরণখোলা রেঞ্জ দিয়ে যাচ্ছি। শতাব্দীর গলায় কাঁপা কাঁপা লালনের গান হঠাৎ থেমে গেল। বনের মধ্যে বড় মিয়ার গন্ধ পেলে তিনি এ রকম আগেও করেছেন। এটা তাঁর একটা ঢং। নৌকায় ছিলেন বিসিএস ১৯৮১ সালের ব্যাচের ফরেন সার্ভিস পাওয়া আমাদের এক বন্ধু। তাঁর জ্ঞান বেশি। তিনি এলান করলেন, ‘গান তো বাউলদের কাছে বন্দনা; বাঘের ভয়ে এই বন্দনা থামবে কেন?’ শতাব্দী হাসলেন।