উদ্দেশ্য মহৎ, কৌশল বেআইনি

জঙ্গি দমনের পর এখন চলমান মাদকবিরোধী অভিযানেও দেখা যাচ্ছে সন্দেহভাজন মাদক কারবারিরা সবাই ‘সশস্ত্র‘! ফলে প্রতিদিনই ঘটছে ‘বন্দুকযুদ্ধ‘। প্রতিদিনই নতুন নতুন মৃত্যুর কারণে নিহত মানুষের সংখ্যাটা নাটকীয়ভাবে বাড়ছে। রোববার এক রাতেই নিহত হয়েছেন অন্তত নয়জন। ইঙ্গিত মিলছে, সন্দেহভাজনদের নির্মূল করাই হচ্ছে সরকারের মাদকবিরোধী নীতির মূল সুর। মাদকবিরোধী এ অভিযানের আরেকটি লক্ষণীয় দিক হচ্ছে, এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কিংবা পুলিশ নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এলিট অংশ র‌্যাব। তারা স্লোগান তুলেছে, ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’। সর্বনাশা মাদকের সর্বগ্রাসী ছোবল, বিশেষত তরুণ সমাজের ওপর, এ থেকে রক্ষা পেতে একটি কার্যকর এবং জোরালো পদক্ষেপ অনেক দিন আগেই প্রত্যাশিত ছিল। সুতরাং, মাদক কারবারিদের কারবার গুটাতে বাধ্য করার বিষয়ে সাধারণভাবে দ্বিমতের কোনো সুযোগ নেই। তবে, সে কারণে যে কৌশল অনুসরণ করা হচ্ছে, তার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এই কৌশল কি আইনসম্মত? উদ্দেশ্য যতই মহৎ হোক না কেন, কাজটি যদি আইনসম্মত না হয়, তাহলে তা কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না।
চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে র‌্যাবের উদ্যোগী ভূমিকার পটভূমিতে মনে পড়ছে র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদের সাম্প্রতিক একটি সাক্ষাৎকারের কথা। প্রথম আলোকে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কথাটি ভুল। তাঁর পাল্টা প্রশ্ন ছিল, তাহলে বিচারে অন্তর্ভুক্ত হত্যাকাণ্ড কোনটি? তিনি তাঁর ভাষ্যমতে ভুল শব্দটি ব্যবহারের দায় ইঙ্গিতে আমাদের গণমাধ্যমের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন (‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড‘ একটি ভুল শব্দ, প্রথম আলো, ১৮ মার্চ ২০১৮)।
র‍্যাবের প্রধান একদিক দিয়ে যথার্থ প্রশ্নই তুলেছেন যে বিচার-অন্তর্ভুক্ত হত্যাকাণ্ড কোনটি? আসলেই তো বিচার-অন্তর্ভুক্ত হত্যাকাণ্ড বলে কিছু নেই; যা আছে তা হলো মৃত্যুদণ্ড। বিচারিক আদালত ছাড়া অন্য কারও এই দণ্ড বা সাজা দেওয়ার অধিকার নেই, বিশেষ করে অপরাধ দমনের কাজে নিয়োজিত কোনো কর্তৃপক্ষ বা বাহিনীর তো নয়ই। তাদের দায়িত্বের পরিধি হচ্ছে অপরাধীকে আইনসম্মত পন্থায় ধরে এনে বিচারের জন্য আদালতের কাছে সোপর্দ করা। আর বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে অভিযোগ যতই গুরুতর হোক না কেন, তা আদালতে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকেই দোষী হিসেবে গণ্য করা যায় না।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিশেষণের প্রতি সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আপত্তি অনেক দিনের। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময়ে যে যৌথবাহিনীর অভিযান পরিচালিত হয়েছে, তখনো এই বিশেষণ প্রয়োগে আপত্তি উঠেছিল। আপত্তি ছিল সরকারের এবং নিরাপত্তা বাহিনীর। সরকার এ কারণে ওই সময়ে ওই অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের দায়মুক্তি দিয়ে সংসদে আইন করেছিল। কোনো কাজ আইনসম্মত হলে তার জন্য দায়মুক্তির প্রয়োজন হয় না। সুতরাং, সেই আমলে সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে সেগুলো ছিল রাষ্ট্র অনুমোদিত হত্যা। আমাদের হাইকোর্ট পরে সে কথাই বলেছেন এবং ওই দায়মুক্তি অবৈধ ঘোষণা করে দোষী ব্যক্তিদের বিচারের নির্দেশ দিয়েছেন। সেসব হত্যার বিচার আজও হয়নি এবং সরকার বদল হলেও রাষ্ট্র সেই বিচারে আগ্রহী নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কথিত বন্দুকযুদ্ধগুলোয় যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের মৃত্যুগুলোকে কী বলা হবে? রাষ্ট্র অনুমোদিত হত্যা (স্টেট স্যাংশন্ড কিলিংস)? এসব বন্দুকযুদ্ধে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের মৃত্যু অবধারিত, তাঁদের কেউ কখনো জখম হয়েও ফেরে না। আর এগুলো তদন্তে, এমনকি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকেও কোনো সুযোগ দিতে রাজি নয় সরকার এবং এসব বাহিনী।
জঙ্গিদমন অভিযানের সময়েও প্রচুর বন্দুকযুদ্ধের কথা আমরা শুনেছি। তখনো বিনা বিচারে অথবা বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়ে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর আপত্তি ও সমালোচনা নাকচ করে দিয়ে উল্টো জঙ্গিদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু ওই কৌশল অনুসরণের ফলে জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়েছে এমন দাবিও তাঁরা করতে পারছেন না। এর আগে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময়েও নাশকতা ও সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে কিছু রাজনৈতিক কর্মীদের ক্ষেত্রেও অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের মোড়কে এই কৌশল অনুসৃত হয়েছে। তখনো সমালোচকদের জামাত-শিবিরের সমর্থক অভিহিত করে বিতর্কটি ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। এখন একই কৌশলের সমালোচনার জন্য সমালোচকদের মাদক কারবারিদের দোসর করার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মাদক কারবারিদের আসল পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে সরকার কি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পেরেছে? নাকি রাজনৈতিক কারণে সেটি সম্ভব নয়? আর এই সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তালিকা কি শুধু নাগরিকদের জন্য? নাকি পুলিশ ও প্রশাসনের যেসব ব্যক্তির নাম শোনা যায়, তারাও সম্ভাব্য বন্দুকযুদ্ধের জন্য অপেক্ষমাণ?
বাংলাদেশে বর্তমানে সেবনীয় মাদকের তালিকার শীর্ষে আছে ইয়াবা। আমরা জানি, ইয়াবার প্রধান উৎস প্রতিবেশী মিয়ানমার। আমরা এ-ও জানি, ইয়াবা আকাশপথে আসে না। এটি আসে প্রধানত সাগরপথে কক্সবাজার হয়ে। কক্সবাজারের সরকারদলীয় সাংসদ এবং তাঁর ছয় ভাইয়ের নাম মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায় রয়েছে (তিন তালিকাতেই সাংসদ বদি, প্রথম আলো, ১৮ জুন ২০১৫)। গত তিন বছরেও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো তদন্তের কথা শোনা যায়নি। সাংসদের ছোট ভাই শুকুর আলীর ইয়াবার চালানসহ আটক হয় ২০১৩‘র ডিসেম্বরে (পাঁচ কোটি টাকার ইয়াবা জব্দ, আটক ২, প্রথম আলো, ১১ ডিসেম্বর ২০১৩)। পাঁচ বছরেও সাংসদভ্রাতার বিরুদ্ধে বিজিবির মামলায় কোনো অগ্রগতির খবর নেই। ইত্যবসরে দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৬ সালের নভেম্বরে সাংসদ দণ্ডিত হওয়ার পর জামিন পেয়েছেন এবং তাঁর জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করায় দুর্নীতি দমন কমিশনের কোনো আগ্রহের আলামত মেলে না।
মাদকবিরোধী অভিযানে বন্দুকযুদ্ধের মডেলটি অত্যন্ত কঠোর ও নিষ্ঠুরভাবে চর্চা করছেন পূর্ব এশিয়ার দেশ ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দুতার্তে। দুই বছরের বেশি সময় ধরে তাঁর এই চর্চা যে দেশটিকে মাদকমুক্ত করে ফেলেছে, এমনটি তিনিও দাবি করতে পারছেন না। কিন্তু এই রাষ্ট্র অনুমোদিত হত্যার নীতির জন্য তাঁর বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তদন্ত শুরু করেছে। তিনি আন্তর্জাতিক আদালতের এখতিয়ার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য রোম সনদ থেকে ফিলিপাইনকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও এই তদন্ত থেকে তাঁর রেহাই পাওয়া কঠিন। কেননা সনদ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার আগেই তদন্তটি শুরু হয়েছে এবং কোনো আন্তর্জাতিক সনদ থেকে রাতারাতি অব্যাহতি পাওয়া যায় না। আন্তর্জাতিক পরিসরে কূটনৈতিক প্রতিকূলতার কারণে তিনি এখন ক্রমশই চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন এবং দক্ষিণ চীন সাগরে সীমানাগত বিরোধে চীনের কাছে কার্যত আত্মসমর্পণ করেছেন। তা ছাড়া তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও এখানে কিছুটা প্রাসঙ্গিক। মিনদানাওয়ের মেয়র থাকাকালে নিজের হাতে খুন করার কথা স্বীকার করার পর এমন ধারণা করা অস্বাভাবিক নয় যে তাঁর কাছে হত্যাই হচ্ছে সমস্যার সমাধান।
ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দুতার্তের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় অনুমোদনে হত্যার অভিযোগ যখন সর্বত্রই আলোচিত হচ্ছে, সেই সময়ে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। সেই ২০১৭ সালের জুন মাসে ৪৭ সদস্যের মানবাধিকার পরিষদ তার ৩৫তম অধিবেশনে সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করে সর্বসম্মতভাবে একটি প্রস্তাব অনুমোদন করে। ওই প্রস্তাবে এই চর্চা বন্ধের জন্য সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এ ধরনের সব অভিযোগ নিরপেক্ষ ও গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমে দায়ী প্রত্যেকের বিচারের দাবিও ওই প্রস্তাবে ছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) বিচারে এ ধরনের ঘটনা যে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, সেই স্বীকৃতিরও উল্লেখ আছে প্রস্তাবটিতে।
এ কেমন নৈতিকতা আমাদের যে আমরা আন্তর্জাতিক ফোরামে যে রাষ্ট্রীয় অপরাধের নিন্দা জানিয়ে তা বন্ধের জন্য সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানাব, সেই অন্যায় কৌশলকেই আমরা অনুশীলন করব? এই দ্বিচারিতা বন্ধ হোক। মাদক কারবারিদের খুঁজে বের করে আটক করুন, বিচার করুন, শাস্তি দিন; কিন্তু সন্দেহের বশে হত্যা কোনো রাষ্ট্রীয় নীতি হতে পারে না।

কামাল আহমেদ, সাংবাদিক