জেনেভায় মানবাধিকার প্রশ্ন

জাতিসংঘে মানবাধিকার কমিশনের সর্বজনীন নিয়মিত পর্যালোচনা, যা ইউপিআর নামে পরিচিত, তার সদ্য সমাপ্ত পর্যালোচনা সভায় বাংলাদেশ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়ার ঘটনায় প্রশংসিত হলেও গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বাক্‌স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিশ্বসভায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়।

পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে গুম, হেফাজতে নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগগুলো তদন্ত এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মতো বিষয়ে দেশে সরকারের তরফে নানা বক্তব্য বা বিষয়গুলো অস্বীকার করা হলেও জেনেভায় আমরা সরকারকে কার্যত নিশ্চুপই দেখলাম। এ ছাড়া আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা ও ডিজিটাল প্রযুক্তি আইনের খসড়া সংশোধন, আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আইনগত সুরক্ষা, বাল্যবিবাহ আইনে বিশেষ ছাড় দেওয়ার বিধি এবং নারী-পুরুষের মজুরিবৈষম্য দূর করার মতো কিছু বিষয়েও সরকার তার অবস্থান পরিষ্কার করতে আরও সময় নিয়েছে।

ইউপিআর প্রক্রিয়ায় কোনো বাধ্যবাধকতার বিষয় নেই, কিন্তু এর সঙ্গে
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মর্যাদার প্রশ্ন জড়িত। এই ফোরামে দাঁড়িয়েই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বর্তমান সরকারদলীয় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণের অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু এখন যদি এসব বিষয়ে তদন্ত ও দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে আশ্বাস দিতেও সরকারকে সময় নিতে হয়, তাহলে এ বিষয়ে প্রশ্ন উঠবেই। আর সেটা শুধু বিশ্বসভায় নয়, নির্বাচনী বছরে দেশের জনগণকে সব থেকে বেশি পীড়িত করবে। এ বিষয়ে দুর্বলতা না থাকলে সরকারের দেশে এক কথা, আর বিদেশে চুপ থাকার কথা ছিল না।

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ বহির্বিশ্বে রীতিমতো একটি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হতে চলেছে। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে ব্রিটেনের মানবাধিকার-বিষয়ক মন্ত্রী তারিক আহমেদ ‘গভীরভাবে উদ্বেগজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার আগ থেকেই জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক স্পেশাল র‍্যাপোর্টিয়ার বাংলাদেশ সফরে আগ্রহ ব্যক্ত করে আসছে।

কিন্তু আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ তাকে স্বাগত জানাতে পারেনি। এক দশকের বেশি সময় ধরে স্পেশাল র‍্যাপোর্টিয়ারকে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি দেখতে স্বাগত জানাতে না পারার লজ্জা বাংলাদেশের জনগণের নয়, এর দায় সরকারগুলোকেই নিতে হবে। এটা পরিহাসের যে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যখন বিশ্বসভায় মুখ উজ্জ্বল করেছে, তখনো কিন্তু উদ্বাস্তুবিষয়ক ১৯৫১ সালের সনদ স্বাক্ষরে বাংলাদেশ গড়িমসি করছে।
আমরা আশা করব, সরকার মানবাধিকার বিষয়ে তার দ্বৈতনীতি পরিহার করবে। ইউপিআর-সংশ্লিষ্ট এমন কিছু বিষয় রয়েছে, সরকার যেখানে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হরহামেশা নানাভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ সোচ্চার থাকে, সেখানে জাতিসংঘে তারা বছরের পর বছর ধরে নীরবতা অবলম্বনকেই কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছে।

গুম থেকে সবার সুরক্ষাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদসহ মানবাধিকারের কয়েকটি সনদের স্বেচ্ছামূলক অঙ্গীকারের প্রশ্নসহ প্রায় ষাটটি সুপারিশ গ্রহণে অসম্মতির বিষয়ে বাংলাদেশ তার মত কেন বদলাতে পারল না, কেন
বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে অনেক দেশের প্রতিনিধিদের উত্তর না দিয়ে চুপ থাকার নীতি নিতে হলো, সেসবের একটি উপযুক্ত ব্যাখ্যা জানার অধিকার দেশের মানুষের রয়েছে।