অনিরাপদ খাদ্য বিষের সমতুল্য

মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছুই নেই। জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক নিরাপদ খাদ্যের। পানি ও খাদ্যবস্তু মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। বেঁচে থাকার পরেই শুধু মানুষের জীবনের অন্যান্য প্রয়োজন পূরণের প্রশ্ন আসে।

খাদ্য বলতে বোঝায় নিরাপদ খাদ্যবস্তু, অনিরাপদ দূষিত খাদ্য নয়। খাদ্য ও বিষযুক্ত খাদ্য একেবারেই দুই জিনিস। এক শিশি বিষ খাইয়ে কাউকে দুই মিনিটে হত্যা করা আর বিন্দু বিন্দু বিষ খাইয়ে এক কোটি মানুষকে পাঁচ বছরে হত্যা করার মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে বলে ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি না।

পার্থক্য শুধু এইটুকু যে প্রথমটিকে আমরা বলব হত্যা আর দ্বিতীয়টিকে বলব নীরব গণহত্যা। হত্যা আর গণহত্যার শাস্তি একই। প্রকারভেদে হত্যার শাস্তি যদি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়, গণহত্যার শাস্তি তিন-চার বছরের জেল এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে না।

আমরা উন্নয়নপিপাসু ও প্রবল গণতন্ত্রপ্রেমী জাতি। আমরা জানি শুধু ভোট-ভাতের সমস্যা আমাদের কাছে বড় নয়। নির্বাচন আর ভোট নিয়ে কথা শুনতে শুনতে মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার জো! তার ফলে অনিরাপদ খাদ্য খেয়ে শরীর খারাপ হওয়ার কথা ভাবার অবকাশ অল্প।

তবে সদাশয় প্রশাসন বসে থাকে না। তারা সারা বছরই কিছু কিছু, তবে বিশেষভাবে রমজান মাস ও কোরবানির ঈদের আগে দৃষ্টিগ্রাহ্য অভিযান চালায়। নোংরা মাঠের মধ্যে শুকাতে দেওয়া নুডলস বা লাচ্ছা সেমাই জব্দ করে, জরিমানা করে প্রতিষ্ঠানের মালিককে এবং কোমরে দড়ি দেন কর্মচারী কিশোর-যুবকটির।

আমরা রিকশাঅলার সঙ্গে পাঁচ টাকার ভাড়া নিয়ে বচসা করে মারামারি করলেও কিংবা বাসের মধ্যে ভাড়া নিয়ে দর-কষাকষি করতে করতে মাথা ফাটাফাটি করলেও বস্তুত আমরা পরম সহনশীল জাতি। সহনশীল বলেই কিলবিল করা পোকাসমৃদ্ধ বিদেশি গমের আটার রুটি ও পরোটা পরম তৃপ্তিতে খাই। রেস্তোরাঁয় অজ্ঞাত মরা মুরগির রান চিবোই। ফাস্ট ফুডের দোকানের ফাঙ্গাশ পড়া হ্যামবার্গার অবলীলায় খেয়ে টিস্যু পেপারে মুখ মুছি। পচা-বাসি যাঁরা খান তাঁরা হয়তো না জেনেই খান, কারণ তাঁদের পেটে ও চোখে ক্ষুধা, কিন্তু যাঁরা তা বিক্রি করেন তাঁরা না জেনে ভুলবশত করেন না।

নিরাপদ খাদ্যের অধিকার মানুষের মৌলিক মানবাধিকার। খাদ্যনিরাপত্তার ধারণা সম্পর্কে ১৯৮৩ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলেছিল, ‘খাদ্যনিরাপত্তা সব মানুষের সারা জীবনের জন্য মৌলিক খাদ্য প্রাপ্তির ভৌত এবং অর্থনৈতিক অধিকারের নিশ্চয়তাকে বোঝায়।’ ১৯৯৬ সালে বিশ্ব খাদ্য সম্মেলনের সুপারিশে বলা হয়েছিল, ‘খাদ্যনিরাপত্তা এমন একটি বিষয়, যেখানে জনগণ সব সময় ভৌত, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পর্যাপ্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যে প্রবেশের অধিকার লাভ করে, তাদের সুস্বাস্থ্য ও কর্মতৎপর জীবনের জন্য স্বাস্থ্য বিধিসম্মত প্রয়োজন মেটায়।’

খুব ভালো পুষ্টিকর খাদ্য খেলেও মানুষের রোগবালাই হবেই। রোগে হোক বা জরা ও বার্ধক্যজনিত কারণে হোক মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু বাসি-পচা, দূষিত, ভেজাল বা বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থমিশ্রিত খাদ্য খেয়ে অকাল মৃত্যুবরণ করা অন্য ব্যাপার। তা রোধ করা সম্ভব। উন্নত দেশগুলো তা অনেক আগেই করেছে।

এই দেশটি উন্নয়নের পরাকাষ্ঠা অথবা পদোন্নতিপ্রাপ্ত উন্নয়নশীল, কিন্তু তার ফুটপাতের খোলা খাবারের দোকান শুধু নয়, নামীদামি রেস্তোরাঁতেও পচা-বাসি খাবার ধুমসে বিক্রি হয়। আজ বিপুলসংখ্যক মানুষ-নারী ও পুরুষকে জীবিকার জন্য ঘরের বাইরে থাকতে হয়। লাখ লাখ শিক্ষার্থী ছেলেমেয়ে সারা দিন বাইরে থাকে। বাধ্য হয়ে তাদের বাইরের দোকানের বা হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবার খেতে হয়।

দূষিত খাবারের ভয়ে বাংলাদেশে পশ্চিমের পর্যটকেরা আসতে চান না, যা আমাদের অর্থনীতির জন্য বড় ক্ষতি। অনেক পর্যটক বাংলাদেশে দু-চার দিনের জন্য এসে দেশ দেখা তো দূরের কথা, ঢাকা নগরীও ঘুরে দেখতে পারেননি, পুরো সময়টাই ল্যাট্রিনে ছোটাছুটি করে কাটিয়েছেন। অনেকে জন্ডিস বাঁধিয়ে দেশে ফিরে গেছেন।

নাগরিক সমাজ ও পরিবেশবাদীদের অব্যাহত দাবির মুখে সরকার ২০১৩ সালে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩’ প্রণয়ন করেছে। আইনটির উদ্দেশ্য ছিল জনগণের নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করা এবং খাদ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুত, সরবরাহ, বিপণন ও বিক্রয়-সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম সমন্বয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা। ওই আইনের পরে ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সরকার একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে ‘বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’ প্রতিষ্ঠা করেছে। চেয়ারম্যান ও চার সদস্যের সমন্বয়ে সেটি গঠিত হয়। এই সংস্থার দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার কাজের সমন্বয় সাধন করা।

অনিরাপদ খাদ্যের পরিস্থিতি আজ বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। এই বিপদ থেকে রেহাই পেতে প্রশাসন ও নাগরিকদের কী করণীয়, তা নিয়ে আলোচনার জন্য স্বপ্রণোদিত হয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) পক্ষ থেকে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এবং আমি দুদিন আগে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করি। নতুন প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তা আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে তাদের কাজ করতে হয়। তাতে যে জটিলতা তা দূর করা আমাদের সংস্কৃতিতে খুব সহজ নয়।

বাংলাদেশের মতো প্রায়োন্নয়নশীল দেশে দুই রকমের সমস্যা: অপুষ্টিকর মানহীন খাদ্য এবং ভেজাল দূষিত খাদ্য। অনিরাপদ খাদ্য রোগের জন্ম দেয়, অপুষ্টিকর খাদ্য কোনো রোগ ছাড়াই স্বাস্থ্যহানি ঘটায়, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস করে, যৌবনেই নর-নারীর যৌন দুর্বলতার কারণ ঘটায়, যার ফলে শুধু দাম্পত্যজীবন অসুখী হয় না, অসুস্থ ও দুর্বল সন্তানের জন্ম হয়, যারা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বলই থাকে। দুর্বল স্বাস্থ্যের জনগোষ্ঠী দিয়ে সুস্থ, সবল, কর্মঠ জাতি গঠন সম্ভব নয়। সেই উন্নয়নশীলতা টেকসই হবে না।

উন্নত দেশের সূচকের প্রধান মানদণ্ড নিরাপদ খাদ্য ও মানসম্মত ওষুধ। বাংলাদেশে প্রস্তুত ওষুধ মানসম্মত ও বিশ্বে প্রশংসিত। কিন্তু এই দেশেই মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে বাজার সয়লাব। তা ছাড়া, ভেজাল ওষুধ বেচাকেনা একটি নির্মম বাস্তবতা। কাগজে দেখেছি মিটফোর্ড জিঞ্জিরায় কি পাওয়া যায় না?

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) জাতীয় মান প্রণয়ন ও মানের সনদ প্রদানকারী সংস্থা। খাদ্যে ভেজাল ও দূষণ প্রতিরোধে এর ভূমিকা খুব বেশি। যদিও এটি শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে।

ফরমালিন ও বিষাক্ত রাসায়নিকের বিরুদ্ধে র‍্যাব, পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। কয়েক দিন আগেও রাসায়নিক দিয়ে পাকানো হাজার মণ আম ধ্বংস করা হয়েছে। রোববার র‍্যাব-পুলিশের ভ্রাম্যমাণ আদালত বনানীর এক সুপারশপকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছেন। মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি, ওজনে কম ও বেশি দামে মাংস বিক্রির অপরাধে জরিমানা। আর পচা-বাসি খাদ্য বিক্রির অভিযোগে নিউমার্কেটের ফাস্ট ফুডের নয়টি দোকানকে ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

ভেজাল ও অনিরাপদ খাদ্যবিরোধী অভিযান শুধু প্রশাসন এবং র‍্যাব ও পুলিশ চালাবে কেন? ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা থেকে সংসদ পর্যন্ত জনপ্রতিনিধিদের কাজটা কী? বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের ভূমিকাটা কী? তাঁদের কেউ কেউ অবশ্য জানেন কীভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ খাসজমি, পাহাড়, বনভূমি, নদ-নদীর পার, খাল-বিল নিজের করে নিতে হয়।

ব্যবসায়ীদের গলায় গামছা দিয়ে চাঁদা আদায় একালে খুব সহজ। সরকারি দলের প্রধান ক্যাডার বাহিনী অনিরাপদ খাদ্যবিরোধী অভিযানে থাকলে প্রশাসনের কাজ সহজ হতো।

মাদকবিরোধী আন্দোলনে তোড়জোড় বেশি। দূষিত খাদ্য মাদকের চেয়ে কম বিপজ্জনক নয়, বরং বেশি। মাদক জীবনীশক্তি শেষ করে, অনিরাপদ খাদ্যে জীবনটাই শেষ হয়।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক