প্রচার-প্রচারণায় সাংসদ

স্থানীয় নির্বাচনের প্রচারে স্থানীয় সাংসদদের সুযোগ করে দিতে বিধিমালায় পরিবর্তন আনার যে উদ্যোগ নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিয়েছে, তা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থীর মাঠ সমতল রাখার নীতির পরিপন্থী বলে মনে করি। বিভিন্ন মহলের প্রতিবাদ ও সমালোচনা সত্ত্বেও ইসির আইন ও বিধিমালা সংস্কারসংক্রান্ত কমিটি এ ধরনের একটি প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে বলে প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়। ১৫ মে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন সেটি অনুমোদিত না হলেও এখন গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে আবার বিধিমালা পরিবর্তনের তোড়জোড় চলছে।

গত ১২ এপ্রিল আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনে মন্ত্রী-সাংসদদের নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল। সেই দাবির এক সপ্তাহের মাথায় বিধিমালা সংস্কারের উদ্যোগ নেয় ইসি। ১৯ এপ্রিল ইসির বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আইন ও বিধিমালা সংস্কার কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর আগেই অবশ্য নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দিন আহমেদ আওয়ামী লীগের প্রস্তাবের বিষয়ে ইসি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন। ইসির বৈঠকের আগে তিনি কীভাবে এমন মন্তব্য করলেন, সেটাও প্রশ্ন বটে।

উল্লেখ্য, পূর্ববর্তী নির্বাচন কমিশন এ ধরনের উদ্যোগ নিলেও সমালোচনার মুখে পরে বাদ দিতে বাধ্য হয়েছিল। আওয়ামী লীগ মন্ত্রী-সাংসদদের ঢালাওভাবে প্রচার-প্রচারণায় অংশগ্রহণের সুযোগ দাবি করলেও ইসি কমিটির প্রস্তাবে শুধু স্থানীয় সাংসদের কথা বলা হয়েছে। অন্য এলাকার সাংসদের এই সুযোগ থাকবে না। বিষয়টি নীতিগত, এলাকাগত নয়। একজন সাংসদ সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন (এমনকি বিরোধী দলের সাংসদও) এবং স্থানীয় প্রশাসনের তদারকিতেও তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা আছে। এ অবস্থায় কোনো এলাকার সাংসদ নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিলে তা স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের একধরনের চাপে ফেলবে। স্থানীয় সাংসদ এলাকার উন্নয়নকাজের সঙ্গেও নানাভাবে সংযুক্ত থাকেন; যা দিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করার সুযোগও থাকবে।

এসব কারণে মন্ত্রী-সাংসদসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনী প্রচারকাজ থেকে বিরত রাখার বিধান চালু করা হয়। বর্তমান নির্বাচন কমিশন সেই বিধান নিশ্চিত করে কুমিল্লা, রংপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশনসহ অনেকগুলো স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন করেছে। কোনো সমস্যা হয়নি।

আজ বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা। আমরা মনে করি, গাজীপুরসহ চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে ইসির উচিত হবে না আচরণবিধি পরিবর্তন করে স্থানীয় সাংসদদের নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। এ ধরনের পরিবর্তন ইসির বিশ্বাসযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা মারাত্মকভাবে খর্ব করবে। তারা যদি একটি দলের দাবি মেনে সাংসদদের প্রচারকাজে নামার সুযোগ করে দেয়, তাহলে অপর দলের দাবিগুলোও আমলে নিতে হবে। আমরা জানি যে বিএনপি গাজীপুরসহ স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছে।

ইতিমধ্যে ইসি এমন অনেক ভূমিকা পালন করেছে, যা তাদের নিরপেক্ষ অবস্থানকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। জনমনে এ ধারণাই প্রকট হয়েছে যে এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি এখন সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে পড়েছে। স্বাধীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত তারা নিতে পারে না। এ অবস্থায় আচরণবিধি পরিবর্তন করে সাংসদদের স্থানীয় সংস্থার নির্বাচনের প্রচারকাজের সুযোগ করে দিলে তাদের ওপর থেকে জনগণের আস্থা পুরোপুরি লোপ পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পক্ষপাতমূলক যেকোনো পদক্ষেপ থেকে ইসি বিরত থাকবে, এটাই প্রত্যাশিত।