তরুণদের উৎপাদন করতে দিন

এবার কালবৈশাখীর তাণ্ডব অনেক বেশি। বেশ কয়েকবার ছোবল দিয়ে গেছে সারা দেশে। বজ্রপাতে অনেকের মৃত্যুও হয়েছে। কালবৈশাখীর সঙ্গে সঙ্গে ছোবল দিয়েছে বাসাবাড়ির বিদ্যুৎও। বিদ্যুতের খামখেয়ালি আচরণে অনেকেরই ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির ক্ষয়ক্ষতিও কম হয়নি। আমার বাসার ফ্রিজটি বেঁচে গেছে তার সঙ্গে লাগোয়া ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজারের জন্য। এই যন্ত্রটি কেবল বিদ্যুৎ সরবরাহের ভোল্টেজ ঠিক রাখে না, বিদ্যুতের ঝটিকা আক্রমণ থেকেও লাগোয়া যন্ত্রকে রক্ষা করে। নিজের জীবন দিয়ে আমার ফ্রিজকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে। ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজারটি মেরামত বা নতুন একটা কেনার খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম যে তরুণ উদ্যোক্তার কাছ থেকে আমি ওই স্ট্যাবিলাইজারটি কিনেছিলাম সে বেচারার কোম্পানিটি আর নেই, বন্ধ হয়ে গেছে!

একটি ইলেকট্রনিক সামগ্রী তৈরির কারখানা কেন বন্ধ হয়ে গেল, যেখানে কিনা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা এবং ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজারের চাহিদা বেড়েছে? আমি জেনেছি, দেশের একটি বড় ফ্রিজ তৈরির কারখানা বছরে প্রায় ৭ থেকে ১০ লাখ ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার আমদানি করে। তারা কেন আমাদের তরুণদের কাছ থেকে কেনে না? সেটির খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলাম আমাদের দেশের অদ্ভুত শুল্কব্যবস্থা।

আপনি যদি বিদেশ থেকে সরাসরি ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার নিয়ে আসেন তাহলে আপনাকে শুল্ক দিতে হবে মাত্র ১ শতাংশ। কিন্তু যদি আপনি আমার হারিয়ে যাওয়া ওই তরুণ উদ্যোক্তার মতো দেশে ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজারের কারখানা গড়তে চান, তাহলে আপনার পরিণতি কী হবে?

ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার দুভাবে তৈরি করা হয়। একটি হলো একেবারে কাঁচামাল থেকে। এর মূল কাঁচামাল হলো একটি কোর, যাতে অ্যালুমিনিয়ামের তার প্যাঁচানো হয়। তার পেঁচিয়ে এটিকে আসলে একটি ট্রান্সফরমারে পরিণত করা হয়। ওই কোর বা অ্যালুমিনিয়াম তারের কোনোটিই আমাদের দেশে উৎপন্ন হয় না। পুরোটাই বিদেশ থেকে আনতে হয়। অ্যালুমিনিয়ামের যে তারের কথা বলছি, সেটির আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ এবং ওই কোরটির আমদানি ও সম্পূরক শুল্ক হলো ২৮ শতাংশ! মানে ১০ শতাংশ আর ২৮ শতাংশ শুল্ক দিয়ে আমাদের তরুণকে লড়তে হয় এমন একটি পণ্যের সঙ্গে, যা কিনা মাত্র ১ শতাংশ শুল্ক দিয়ে দেশে নিয়ে আসা যায়। তাই যদি হবে, তাহলে কোন প্রতিষ্ঠান এগুলো নিজেরা বানাতে চাইবে?

আপনি বলতে পারেন, একেবারে কাঁচামাল থেকে বানানোর দরকার কী। ট্রান্সফরমার নিয়ে এসেই তো এটি বানিয়ে ফেলা যায়। হ্যাঁ, যায়, তবে তখনো তরুণটিকে আমদানি শুল্ক দিতে হবে ১০ শতাংশ।

বোঝাই যাচ্ছে, আমাদের যে রাষ্ট্রীয় নীতি, সেটি উৎপাদনে, বিশেষ করে যেসব যন্ত্রপাতি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়বে, তার সঙ্গে এখনো অনেক জায়গায় সাংঘর্ষিক রয়ে গেছে। এ নীতি মূলত ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি নীতির উত্তরাধিকার, যারা কখনোই বাঙালি উৎপাদক হোক, এটি চায়নি। এই অস্বাভাবিক নীতির ফলে আগ্রহী শিল্প উদ্যোক্তারা নিজেদের কারখানা বন্ধ করে দিয়ে আমদানিতে ঝুঁকে পড়ছেন। এই নীতি কেবল দেশীয় কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে না, এটি একই সঙ্গে আমাদের তরুণদের নতুন নতুন দক্ষতায় দক্ষ হয়ে উঠতেও দিচ্ছে না।

ভেবে দেখুন, কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের ১০ লাখ ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার যদি আমাদের তরুণেরা উৎপাদনের সুযোগ পায়, তাহলে কতজন তরুণ উদ্যোক্তা হয়ে উঠবে আর কতজন তরুণের কর্মসংস্থান হবে!

অনেকেই ভাবছেন কাঁচামালের ওপর এমন সুবিধা আরোপ করলে অন্যরা লাভবান হবেন। অথচ সামান্য চেষ্টা করলে এই অপকর্মটি যাতে না হয়, সেটিও রোধ করা সম্ভব। এর জন্য সামান্য উদ্ভাবনী হলেই হয়। যে অ্যালুমিনিয়ামের তার ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজারের জন্য দরকার, সেটির প্রস্থচ্ছেদের মাপ ১ দশমিক ৫ মিলিমিটারের বেশি হবে না। কাজে ওই মাপের জন্য আলাদা এইচএস কোড চালু করলেই ল্যাঠা চুকে যায়। এ ছাড়া যেসব উৎপাদনকারী বিনিয়োগ বোর্ডে নিবন্ধিত এবং যাদের মূসক নিবন্ধন আছে, কেবল তাদের ওইগুলো আমদানি করতে দিলেই হয়।

ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজারের দেশি শিল্পকে বাঁচানোর একমাত্র বুদ্ধি হলো অসম লড়াই থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া। এ জন্য কেবল ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজারের জন্য দরকারি ১ দশমিক ৫ মিলিমিটারের কম অ্যালুমিনিয়ামের তারের ওপর শুল্ক ১ শতাংশ এবং ট্রান্সফরমার কোরের শুল্ক ৫ শতাংশে নামিয়ে নিয়ে আসা। অন্যদিকে যারা দেশের বাইরে থেকে সম্পূর্ণ সংযোজিত ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার আমদানি করবে, তাদের শুল্কহার ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করে দেওয়া দরকার।
২০১৭-১৮ সালের বাজেটে কম্পিউটার ও স্মার্টফোনের উপকরণ ও কাঁচামালের মোট ৯৪টি পণ্যের শুল্ক হরেদরে ১ শতাংশ করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে দেশেই এখন ল্যাপটপ, স্মার্টফোনের কারখানা চালু হওয়ার কেবল সম্ভাবনাই সৃষ্টি হয়নি বরং আগামী কিছুদিনের মধ্যে একাধিক কারখানা চালুও হয়ে যাবে।

আমাদের পুরোনো ধ্যানধারণার অনেকখানি জুড়ে আছে এ দেশে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি উৎপাদন করা সম্ভব নয়, আমরা কেবল ভোগ করে যাব। অথচ বাংলাদেশে প্রতি মাসে যত স্মার্টফোন বিক্রি হয়, পৃথিবীর অনেক দেশে তত লোকই নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির প্রসারের ফলে দেশে ইলেকট্রনিক পণ্যের ব্যবহার বেড়েছে। এগুলোর কাঁচামাল আমদানি, প্রযুক্তির ব্যবহার সবটাতেই এখনো অনেক বাধা। এ বাধাগুলো অপসারণ করা দরকার। তাতে বিপুলসংখ্যক তরুণ নিজেদের কারখানা স্থাপনে আগ্রহী হবেন। তাতে বিদেশি মুদ্রার কেবল সাশ্রয় হবে না, হবে আরও বিপুলসংখ্যক তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থানের সুযোগ।

মুনির হাসান: প্রথম আলোর যুব কর্মসূচির সমন্বয়ক