ডিজিটাল বিলের সংশোধনী

ডিজিটাল বিলের আপত্তিকর ধারাগুলো সংশোধনে সরকারের তরফে সৌজন্য
ও সমঝোতামূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রাথমিক বহিঃপ্রকাশকে আমরা সতর্কতার সঙ্গে স্বাগত জানাই।
আমরা আসলে ভুলেই গিয়েছিলাম কোনো একটি জনগুরুত্বসম্পন্ন ও সংবেদনশীল আইন প্রণয়নে সরকার এ রকম একটি আপসমূলক গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে। আমরা আশা করব, আইনমন্ত্রী ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রীর সক্রিয় অংশগ্রহণে আইন মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এবং সংবাদপত্র পরিষদসহ গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের মধ্যে যে বৈঠক মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হলো, তা একটি রোল মডেল হিসেবে গণ্য হবে। আইনমন্ত্রীর এই উপলব্ধি যথার্থ যে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিপরীতে কোনো আইন সাংবিধানিকভাবে করা যাবে না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাহাত্তরের সংবিধানে আলাদাভাবে ‘সংবাদক্ষেত্রে’ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন, যা আজও সংবিধান তৈরির ইতিহাসে একটি বিরল সংযোজন হয়ে আছে।

তবে প্রস্তাবিত ডিজিটাল আইন যেহেতু বাক্‌স্বাধীনতা-সংশ্লিষ্ট, তাই শুধু সাংবাদিক নয়, মানবাধিকারকর্মীসহ নানা পেশার অংশীজনের সুপারিশ ও উদ্বেগকেও বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। কারণ, গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা লিখিতভাবে প্রস্তাবিত বিলের ত্রুটিবিচ্যুতিগুলো ষোলো আনাই তুলে ধরতে পেরেছেন, তা ধরে নেওয়া যাবে না। এ প্রসঙ্গে আমরা ডিজিটাল বিলের ত্রুটিবিচ্যুতি বিষয়ে প্রথম আলোয় প্রকাশিত তিন পর্বের সিরিজ প্রতিবেদনকে (২১-২৩ মে ২০১৮) বিবেচনায় নিতে অনুরোধ জানাই।

পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে আপত্তিকর খবর মূল্যায়ন করার ক্ষমতাদান এবং তাদের অনুরোধ পাওয়ামাত্রই কোনো ওয়েবসাইট ব্লক করতে বিটিআরসিকে ‘তাৎক্ষণিক’ তা তামিল করতে বলা নিঃসন্দেহে একটি ভয়ংকর বিধান। এটা বিলোপ করতে হবে। বিতর্কিত ৫৭ ধারার উপাদানগুলোর কোনো কিছুকে অপরাধ হিসেবে রাখতে চাইলে তা নির্দিষ্ট ও স্পষ্ট করতে হবে।

দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার সঙ্গে সংগতি রেখে কোটি কোটি টাকার অর্থদণ্ড এবং অনুপাতহীনভাবে ১০ থেকে ১৪ বছরের মতো কারাদণ্ডের বিধানাবলিকে বিদ্যমান দণ্ডবিধির আলোকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। ন্যূনতম সাজা নির্ধারণ করা আদালতের পরম ক্ষমতা হরণ করা। এটাও বিলোপ করতে হবে। ২০১৫ সালে বর্তমান প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত আপিল বিভাগের একটি সর্বসম্মত রায় বলেছে, মূল অপরাধী এবং সহায়তাকারীর সাজা একই হতে পারবে না। অথচ বিএনপি-স্টাইলে তারা ডিজিটাল বিলের ৩৫ ধারায় বলেছে, মূল অপরাধীর সঙ্গে সহায়তাকারীও একই দণ্ড পাবেন। এটা অবশ্যই বিলোপ করতে হবে।

আমরা বিশ্বাস করতে চাই যে সরকারের মূল উদ্বেগ সাইবার অপরাধ দমন, সংবাদক্ষেত্র দলন নয়। সাইবার সন্ত্রাসী এবং সাইবার জঙ্গিদের কিছু নাশকতামূলক অপরাধ ও তৎপরতা ইতিমধ্যেই বিরাট উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। অনলাইনে সাংবাদিকতার নামে এবং নিউজ আউটলেটকে ব্যবহার করে অশুভ মহল যাতে কোনো অঘটন না ঘটাতে পারে, সে জন্যও আইনে উপযুক্ত রক্ষাকবচ থাকতে হবে। তবে সে জন্য আইনপ্রণেতারা প্রতিবেশীসহ বিশ্বের অপরাপর দেশ যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, সেসব তাদের বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ, ডিজিটাল আইন এমনই একটি বিশেষ আইন, যাকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এবং আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে যথাসাধ্য সংগতিপূর্ণ করাই হবে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। তবে মূল চ্যালেঞ্জ হলো সাইবার জগতের ক্ষতিকর ও মন্দ দিকগুলো নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধের নামে রাষ্ট্র যেন পুলিশি রাষ্ট্র গঠনের পথে আরও একটি বড় পদক্ষেপ নিয়েছে বলে প্রতীয়মান না হয়।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনলাইন ও অফলাইনের (মুদ্রণ মাধ্যম) অধিকার সমান থাকবে। তাই অপরাধের দণ্ড একই হতে হবে, কিন্তু ডিজিটাল বিলে তা নেই। বিলের অন্যতম ঘাটতি হলো ব্যবস্থা গ্রহণে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের কোনো রক্ষাকবচ রাখা হয়নি। তবে সংসদীয় কমিটির সভাপতি প্রেস কাউন্সিলকে অন্তর্ভুক্ত করার যে ইঙ্গিত করেছেন, সেটার পরিধি আরও বাড়ানো যায় কি না, তা ভাবা যেতে পারে। আশা করব, সংশোধিত বিলের খসড়া জনমত যাচাইয়ের জন্য প্রকাশ করা হবে।