সোনার মেয়ের সওয়ালের জবাব কী

সাদিয়া
সাদিয়া

আমাদের অফিসে একটা সোনার মেয়ে এসেছে। বাচ্চা একটা মেয়ে। তার নাম মৌ। ভালো নাম সাদিয়া। মেয়েটা ছোটখাটো। এত হালকা যে মনে হয় আমি যদি জোরে ফুঁ দিই, সে উড়েই যাবে। সঙ্গে এসেছিলেন তার মা। সে ঢাকায় এসেছে, শিক্ষামন্ত্রী ডেকেছেন, তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। সংবর্ধনা কেন? কারণ, মেয়েটি সোনার মেয়ে। টেবিল টেনিস খেলে দুটি সোনার মেডেল সে পেয়েছে, জাতীয়ভাবে। বাহ্! কী আনন্দের খবর। মৌয়ের বড় বড় চোখ, চোখের তারায় বিজয়ীর ঝিলিক।

তবে খবর এতটুকুন নয়। খবর হলো সে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে শিশুদের টুর্নামেন্টে নয়, বড়দের টুর্নামেন্টে। সে বড়দের সঙ্গে খেলে। মানে সে আমাদের টেবিল টেনিসের মেয়েদের ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন। এসেছে সে নড়াইল থেকে।
আমি তাকে বলি, ‘এই, কিশোর আলো পড়ো?’
সে বলে, ‘মাঝেমধ্যে পড়ি।’

এত সফল একটা মেয়ে, তার বয়স মাত্র ১৩ বছর, বড়দের হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়, তাকে কী দিয়ে সমাদর করি। রোজার মাস, সে রোজা আছে। এক কাপ চা-ও তো খাওয়াতে পারব না। আমি বলি, ‘আমি তোমাকে খুশি করতে চাই, বলো, আমার কাছ থেকে কী পেলে তুমি খুশি হবে?’ সে বলে, ‘আপনি বসেন। আমার কিছু লাগবে না। আমার কথা শোনেন।’ মৌ আর তার মা তাঁদের কাহিনি শোনান। আমাদের পত্রিকা অফিসের ছয়তলায়। পাশে কিশোর আলোর কাজ চলছে। কিশোর-কিশোরীরাও এসেছে। তারা ছাপা হওয়ার আগে কিশোর আলোর পাতা পড়ে দিচ্ছে ভুল বের করার জন্য।
আর একটা ছোট্ট মেয়ে বলছে তার গল্প।

মৌয়েরা দুই বোন। মৌয়ের বড় বোন এইচএসসি পাস করেছে। তার নাম মীম। মীমও টেবিল টেনিসে চ্যাম্পিয়ন ছিল।
তাদের বাবা বহুদিন ছিলেন শয্যাশায়ী। তারপর মারা গেছেন। তাঁর চিকিৎসা করতে গিয়ে তারা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। মা দুই মেয়েকে নিয়ে নড়াইলে একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। বাসাভাড়া দিতে হয় পাঁচ হাজার টাকা। দুই মেয়ে টেবিল টেনিসের চ্যাম্পিয়ন। তাদের চাকরি দিয়েছে আনসার বাহিনী। মীম পায় ১০ হাজার টাকা। মৌ পায় ৭ হাজার টাকা। মাসে।
আমি বলি, ‘বাহ্! এই বয়সেই এত টাকা বেতন পাও! তোমাদের আর চিন্তা কী?’
ওরা বলে, ‘চিন্তা মানে...৫ হাজার টাকা বাসাভাড়া। আর থাকে ১২ হাজার। সংসার চলে যায়। কিন্তু...’
‘কিন্তু আবার কী?’
মৌ বলে, ১৩ বছরের মৌ বলে, ‘সংসার তো চলছে আমার খেলার ওপরে। আগে আপা ভালো খেলত। এখন আর আগের মতো পারে না।
ওর মা বলেন, ‘মৌয়ের জন্য মীমের চাকরিটা আছে।’

চাকরি মানে খেলা। মীম যদি না খেলে বা খেলার ফল ভালো করতে না পারে, তাহলে দুই বোন আর বেতন পাবে না। কাজেই ১৩ বছরের মীমকে খেলে যেতে হয়। এরই মধ্যে সে পাঁচটা দেশ ভ্রমণ করেছে খেলা নিয়ে। থাইল্যান্ড, ভারত, মালদ্বীপ, চীন ও শ্রীলঙ্কা...। সে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন। আরও ভালো করতে চাইলে তাকে কোচিং করতে হবে। ক্যাম্পে যেতে হবে। অন্তত ভারতে গিয়ে যদি সে ট্রেনিং করে আসতে পারে, নতুন কিছু টেকনিক তো শিখে আসতে পারবে...
কিন্তু তার টাকা কই। খেলার জন্য ঢাকায় আসতে হয়। এখানে-ওখানে যেতে হয়...
একবার হলো কি, ঢাকায় এসেছে। পরদিন তার পরীক্ষা। তারা বাসে ফিরছে। বাস আটকা পড়েছে নদীর এই পারে। ফেরি পাওয়া যাবে না, এত বড় লাইন...তাহলে কালকে আর পরীক্ষা ধরা হবে না, শেষে এখানে-ওখানে ফোন করে বাসটাকে ফেরিতে তুলতে হলো, টাকা লাগল ২ হাজার ৫০০...
আমি বলি, ‘সংগ্রাম তো করতেই হবে। দঙ্গল ছবিটা দেখেছ না? প্রথমে কষ্ট, তারপর হাসি...’
মৌ বলে, ‘ওই ছবি দেখেছি। কিন্তু সমস্যা হলো আমি ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল।’
আমি আনন্দে নেচে উঠি প্রায়। তাই তো আমরা চাই। ক্লাসে ফার্স্ট হবে, আবার খেলাধুলায় ভালো।
ওর মা বলেন, ‘ও তো বন্ধুসভা নড়াইলের একজন সম্পাদক, আমিও সম্পাদক।’
আমি বলি, ‘বাহ্! মা-মেয়ে দুজনেই বন্ধুসভা করেন, তাই তো চাই। তো সমস্যা কী?’
‘সমস্যা হলো, আমি তো পড়াশোনা করতে চাই। ডাক্তার হতে চাই। এখন আমি যদি না খেলি, খেলায় খারাপ করি, তাহলে আমাদের দুই বোনের বেতন আর আনসার থেকে আসবে না। আর আমি যদি পড়াশোনায় ভালো করতে চাই, তাহলে তো আমাকে পড়াশোনাই সিরিয়াসলি করতে হবে। কোনো একটা মেডিকেল কলেজে চান্স পেতে হবে...।’
মৌয়ের গলা ধরে আসে। চোখের নিচে জল ছলছল করে।
‘আমি খেলব, নাকি পড়ব? আমি তো আনন্দ নিয়ে খেলতে চাই, আবার আনন্দ নিয়ে পড়তে চাই...আমার ওপরে পুরো সংসারের একটা ভার...আমি তো আনন্দ নিয়ে পড়া আর খেলার কোনোটাই করতে পারি না, চাপ...ভীষণ চাপ...।’

আমি আমার জীবনে এত বড় উভয়সংকট আর কখনো দেখিনি। আমি কিশোর আলোর সম্পাদক। সারা দেশের বাচ্চাদের উপদেশ দিয়ে বেড়াই। এই বাচ্চাটাকে আমি কী পরামর্শ দেব? সে কি পড়বে, নাকি খেলবে? সে কেন শুধু আনন্দের জন্য খেলতে পারবে না? সে কেন শুধু আনন্দের জন্য পড়তে পারবে না?

আমার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর নেই। আমার কিশোর আলোর কিশোরবাহিনীর বাচ্চাদের চেয়েও বয়সে ছোট একটা মেয়ে, যাকে বলি সোনার মেয়ে, সংসার নামে একটা বিশাল লোহার বল কাঁধে আমার সামনে একটা প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার কাছে কোনো জবাব নেই। বাস্তবতা এড়াতে আমি আল মাহমুদের কবিতা আবৃত্তি করি:
লিয়ানা রে লিয়ানা সোনার মেয়ে তুই
কোন পাহাড়ে তুলতে গেলি জুঁই...

মনে মনে নিজেই রচনা করি:
সাদিয়া রে সাদিয়া, সোনার মেয়ে তুই
পাথর ভারী জীবন মাগো কোন জীবনে থুই...
আমার কাছে কোনো জবাব নেই মৌ আর তার মায়ের প্রশ্নের।
কোনো একটা করপোরেট, কোনো একটা ব্যবসায়ী গ্রুপের কাছে হয়তো সমাধানের চাবি আছে। থাকলে দয়া করে ই-মেইল করুন: [email protected]

আনিসুল হক : প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক