ট্রাম্প না কিম, কে কাকে নিয়ে 'খেলছেন?'

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন


যুক্তরাষ্ট্র-উত্তর কোরিয়া শীর্ষ বৈঠক থেকে কি আদৌ শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো রাস্তা বেরোতে পারে? নাকি ব্যাপারটা একধরনের বৈঠক হয়েছে-বৈঠক হয়নি গোছের কিছু হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি? সবশেষ খবর পাওয়া অবধি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, আলোচনার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি। এমনকি নির্ধারিত ১২ জুনেই অনুষ্ঠিত হতে পারে।

এর আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প পিয়ংইয়ংয়ের ‘প্রচণ্ড ক্রোধ আর স্পষ্ট বৈরিতা’কে দায়ী করে বৈঠক বাতিল করেন। এর কয়েক ঘণ্টা পরেই উত্তর কোরিয়া এক বিবৃতিতে এই বৈঠকের ব্যাপারে দেশটির নেতা কিম জং-উনের বিরাট প্রত্যাশা ছিল জানিয়ে বলে, তারা এখনো ট্রাম্পকে তাঁর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য ‘সময় ও সুযোগ’ দিতে রাজি আছে। ওই বিবৃতিতে পিয়ংইয়ং বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার জন্য ওয়াশিংটনের ঘাড়ে দোষ চাপাতে চেষ্টা করে ইঙ্গিত দেয় যে উত্তর কোরিয়ার নেতাই বরং কূটনৈতিক প্রক্রিয়াকে বাঁচানোর জন্য একজন পরিপক্ব রাষ্ট্রনায়কের পরিচয় দিচ্ছেন।

এর পরপরই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোরিয়ার বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, আলোচনার দরজা খোলা আছে। তবে কথাটাকে আক্ষরিক অর্থে না নেওয়াই হয়তো ঠিক। ট্রাম্প ক্ষণে ক্ষণে রং বদলানো ঘটনাটি সম্পর্কে নিজেই সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘প্রত্যেকই তার খেলাটা খেলছে।’

বাজারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নিয়ে একটা চালু ধারণা, নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার আশায় তিনি মুখিয়ে আছেন। তাই একদম শুরুতে কিমকে ‘রকেটম্যান’ বলে অভিহিত করে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে ‘আগুন, ক্রোধ আর শক্তি বৃদ্ধি’র হুমকি দিলেও পরে দক্ষিণ কোরিয়ার দূতালিতে হুট করেই উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় বসতে রাজি হয়ে যান। ধারণাটা সম্ভবত রটনাই।

বরং এমনটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী ওয়াদা—আমেরিকা প্রথম—পূরণে বদ্ধপরিকর; এমনকি সেটা দেশের জন্য ভবিষ্যৎ ক্ষতির কারণ হলেও। আমেরিকান ভোটারদের কাছে তাঁর অন্যান্য ওয়াদার মধ্যে একটা ছিল কিম জং-উনের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র থেকে আমেরিকাকে সুরক্ষিত করা। এক বছর যাবৎ ট্রাম্পের বিদেশনীতি-পরিকল্পকেরা এই লক্ষ্যেই কাজ করে আসছিলেন।

মূলত, সে কারণেই দক্ষিণ কোরীয় কূটনীতিকেরা যখন বার্তা দেন পিয়ংইয়ংয়ের স্বৈরশাসক তাঁর দেশের বিরুদ্ধে পশ্চিমের অর্থনৈতিক অবরোধ উঠিয়ে নেওয়ার বিনিময়ে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে রাজি আছেন, তখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দ্রুতই তাতে সায় দিয়ে বসেন। রাজনীতি ও কূটনীতিতে অনভিজ্ঞ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্ভবত ভেবেছিলেন, যেভাবে চাপ দিয়ে নিজের আবাসন ব্যবসায় তিনি সুবিধা আদায় করে থাকেন, ঠিক সেভাবেই হম্বিতম্বি করে কিম থেকে কূটনৈতিক জয় আদায় করে নেবেন। কিন্তু তিনি সম্ভবত আমেরিকার সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় উত্তর কোরিয়ার দীর্ঘ চেষ্টা এবং পারমাণবিক অস্ত্র ধ্বংসে মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ইতিহাস জানতেন না।

কিমের সঙ্গে বৈঠকে যে ঝুঁকি রয়েছে, এটা মার্কিন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা জানতেন। তাঁরা ভয় পাচ্ছিলেন, নিজের মুখ বাঁচিয়ে একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটা খারাপ রফা করে বসতে পারেন। এমনকি আমেরিকার জন্য ছাড় আদায়ের বিনিময়ে উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক শক্তিধর বলে স্বীকৃতিও দিয়ে বসতে পারেন।

বৈঠকের প্রস্তুতি চলার মধ্যেই একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠছিল: ওয়াশিংটন ও পিয়ংইয়ংয়ে এমন মানুষের অভাব নেই, আলোচনা ভেস্তে যাওয়াতেই যাদের স্বার্থ নিহিত। এর একটা ইঙ্গিত মেলে যখন যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়া রুটিন সামরিক মহড়ার অজুহাতে সিউলের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিল করার পাশাপাশি পিয়ংইয়ং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক বাতিলেরও হুমকি দেয়। একপর্যায়ে তারা পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের বিষয়টি আলোচনার টেবিল থেকে সরিয়ে নেয়। উত্তর কোরিয়ায় একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, তাঁর সরকার বৈঠক বাতিল করবে যদি আমেরিকানরা ‘আমাদের কোণঠাসা করে এবং এককভাবে পরমাণু কর্মসূচি বাতিল করতে বাধ্য করে’।

ওয়াশিংটনে প্রথম থেকেই এই আলোচনার বিপক্ষে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন। তিনি এ ক্ষেত্রে ‘লিবীয় মডেল’ অনুসরণের পক্ষে। বোল্টনের তৈরি করা পরিকল্পনাতেই লিবিয়ার পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস করেছিলেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি। এরপর গাদ্দাফির পরিণতির কথা সবাই জানেন। বোল্টন উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক সমাধানে বিশ্বাসী। তিনি সম্ভবত মনে করেন, কোরীয় উপদ্বীপকে বধ্যভূমি বানানোই হচ্ছে শান্তি প্রতিষ্ঠার সহি তরিকা।

নিউইয়র্ক টাইমসের এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে উইলসন সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল স্কলার্সের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রবার্ট এস লিটওয়াককে উদ্ধৃত করে বলেছে, উত্তর কোরিয়া সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের বিষয়টি কখনই আলোচনার টেবিলে আনতে রাজি হবে না। তাঁর মতে, ট্রাম্পকে ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে যে আপসরফা হয়েছিল, সে রকম কিছু করতে হবে। ঠিক যে চুক্তি থেকে মাত্র কয়েক দিন আগেই ট্রাম্প সরে এসেছেন।

কিম অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। কঠোর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় উত্তর কোরিয়া অর্থনৈতিক দুরবস্থায় আছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিমের অর্থ, বিদেশি বিনিয়োগ, প্রযুক্তি, সবই দরকার। কিন্তু তাঁর জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কথিত ‘তিনি নিরাপদ থাকবেন, তিনি সুখে থাকবেন, তাঁর দেশ ধনী হয়ে যাবে’—শেষ কথা নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী উইলিয়াম পেরির মতে, উত্তর কোরীয়দের জন্য ‘ধনী হওয়া’ গৌণ বিবেচনা। ‘আমি যদি কিছুমাত্র ওদের বুঝে থাকি, নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টা ওদের কাছে অন্য সবকিছুর আগে। ওরা জানে আমরা ওদের পরাস্ত করা ক্ষমতা রাখি এবং বিশ্বাস করে আমরা তা করতে চাই।’ পাশাপাশি ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে তাঁকে দেশটির ক্ষমতার আসল চাবিকাঠি যাদের হাতে, তাদের আশ্বস্ত করতে হবে যে তিনি আর্থিক সচ্ছলতার বিনিময়ে উত্তর কোরিয়ার অহংকার—এর পারমাণবিক কর্মসূচিকে—ছুড়ে ফেলছেন না। এই ‘অহংকার’ জিম্মাদারি কিম বাপ-দাদার উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন।

বলতে কি, ট্রাম্প-কিম শীর্ষ বৈঠক নিয়ে যতই বাগ্‌যুদ্ধ হোক, যদি আদৌ কোনো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় শেষ পর্যন্ত, তা থেকে ফলপ্রসূ কোনো সমাধান বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। পলিটিক্যাল থিওরিস্ট হানা আরেন্টকে ধার করে বলা যায়, পরস্পর বিবদমান এই দুই দেশের সম্পর্ক আগামী দিনগুলোতেও ক্ষমতার মৌল ধর্মকে অনুসরণ করেই আবর্তিত হবে। উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে বর্তমান আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হয়তো আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চাইবেন। তবে ঠিক যে সময়ে তাঁর প্রশাসনের মনোযোগ আরেকটি পারমাণবিক হুমকি—ইরানের দিকে—দিচ্ছে, তখন আশা করা যায়, তিনি কোনো সামরিক সমাধানের দিকে যাবেন না। উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বরাবরই উদাসীন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বেলায় তার সেটাই ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

রওশন জামিল চৌধুরী, সাংবাদিক ও অনুবাদক
[email protected]