বহু জাতি-উপজাতির দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র সম্ভব?

মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ৯ মের নির্বাচনে রাতারাতি বদলে গেল। ৯২ বছর বয়সী মাহাথির মোহাম্মদকে আবার প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসানোর মধ্য দিয়ে ভোটাররা ইউনাইটেড মালয়েস ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (ইউএমএনও) ৬১ বছরের নির্বিঘ্ন শাসনের অবসান ঘটালেন। কয়েক দিনের মধ্যেই গদি হারানো নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত শুরু হলো এবং দীর্ঘদিন কারাগারে থাকা আনোয়ার ইব্রাহিম মুক্তি পেয়ে রাজনীতিতে ফিরলেন।

অবাক করার বিষয়, এই ‘নীরব বিপ্লব’ ঘটার সময় একফোঁটা রক্ত ঝরেনি। ধর্মীয়, জাতিগত ও ভাষাগতভাবে ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের এই দেশে সহিংসতার হার কম হওয়া আসলেই এক বিস্ময়ের ব্যাপার। কিন্তু মালয়েশিয়ার এই শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর উদ্‌যাপনের মুহূর্তে একটি প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। সেটি হলো, এ ধরনের একটি বিভক্ত সমাজে বহুদলীয় গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারবে তো?

ইউএমএনও প্রথম দিকে জাতিগত সংখ্যাগুরু মালয়দের শক্তিশালী করার রূপকল্প নিয়েই মালয়েশিয়ার নেতৃত্ব দিয়েছে। পরে দলটি চীনা এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত সংখ্যালঘুদের ছোট ছোট দল নিয়ে একটি মধ্যপন্থী জোট গঠন করে। ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতা লাভের সময় ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে এই দলটিই দেনদরবার করেছিল। কূটাভাষ হলো এই যে, ইউএমএনওর নেতৃত্বাধীন জোট মধ্যপন্থী অবস্থানকে একচেটিয়াভাবে কুক্ষিগত করার কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই তারা নির্বাচনে মালয় এবং অ-মালয়দের নিয়ে গঠিত বিরোধী জোটের বিরোধিতার মুখে পড়ে যায়।

মালয়দের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র দল হিসেবে ইউএমএনও যে মর্যাদা ভোগ করেছে, সেই মর্যাদা ১৯৬৯ সালের নির্বাচন পর্যন্ত হুমকির মধ্যেই ছিল। ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হওয়ার কারণে বিপুলসংখ্যক মালয়ি ভোটারের ইউএমএনওর নেতৃত্বাধীন জোট ছেড়ে মালয়েশিয়ান ইসলামিক পার্টিতে (পিএএস) যোগ দেওয়ার বিষয়টি ঢাকা পড়ে যায়।

অন্যদিকে ব্যালটভিত্তিক ভোটব্যবস্থা চালুর সুবাদে আগের চেয়ে ভালো নির্বাচনী সমন্বয় সুবিধা পেতে থাকে চীনভিত্তিক বিরোধী দলগুলো। ফলে সামগ্রিক জনসমর্থন বাড়াতে ব্যর্থ হলেও তারা কিছু আসন বাড়াতে সক্ষম হয়।

নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেল, ইউএমএনওর জনসমর্থন কমছে এবং মালয়িরা এই ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল যে ইউএমএনওর ছত্রচ্ছায়ায় তারা যে রাজনৈতিক প্রাধান্য ভোগ করে, তা দুর্বল হয়ে পড়ছে। এর ফলে দ্রুতই জাতিগত দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এর মাধ্যমে দেশটিতে বহুদলীয় গণতন্ত্রের একটি সংক্ষিপ্ত নিরীক্ষার সমাপ্তি ঘটল।

এই শূন্যতার মধ্য থেকে নাজিব রাজাকের বাবা আবদুল রাজাক হুসাইনের উত্থান ঘটল। তিনি নৃতাত্ত্বিক মালয়িদের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দিয়ে এবং পিএএস ও অন্য বিরোধী দলগুলোকে বিভিন্ন প্রলোভন দিয়ে নিজের পক্ষে আনলেন। তিনি বারিসান ন্যাশনাল নামের একটি মোর্চা গড়লেন। এর মাধ্যমে ইউএমএনওর আধিপত্য আবার ফিরিয়ে আনলেন। ওই সময় আবদুল রাজাক শুধু বৈধতার পলেস্তারা গায়ে লাগানোর জন্য নির্বাচন দিতেন এবং এর মাধ্যমে তিনি লোক দেখানো গণতন্ত্রচর্চার রেওয়াজ শুরু করেছিলেন।

তবে দৃশ্যমান একদলীয় রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও পিএএসের মতো কট্টর দলগুলোকে ইউএমএনও কাবু করতে পারছিল না। আট বছর সহাবস্থানের পর পিএএস তার মূল ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত কেলান্তান এলাকায় ইউএমএনওর কাছে হেরে গেলেও সে প্রতিরোধ অব্যাহত রাখে। ইউএমএনও ‘মালয়ি ঐক্য’ স্লোগানে সব মালয়িকে এক ছাতার নিচে আনার উদ্যোগ নেয়। মালয়ি পরিচয়ের সব রাজনৈতিক দলকে বৈধতা দেয়। অন্যদিকে পিএএস কট্টর ইসলামি জাতীয়তাবাদ নিয়ে ইউএমএনওর বিরোধিতা শুরু করে। পিএএসের বর্তমান সভাপতি মৌলভি হাদি আওয়াং ১৯৮১ সালে ঘোষণা করেন, ঔপনিবেশিক গণতন্ত্র আত্তীকরণ করা এবং অনৈসলামিক আইন প্রণয়ন করার কারণে ইউএমএনও সরকারের নিন্দা করা প্রত্যেক মুসলমানের ইমানি দায়িত্ব।

ওই বছরই প্রথম মাহাথির ক্ষমতায় আসেন (১৯৮১ সালের জুলাই থেকে তিনি একটানা ২০০৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন)। পিএএসের পাল্টা জবাব হিসেবে তিনি মালয়েশিয়ায় ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় খোলেন, ইসলামি ব্যাংকিং ও ইসলামি আমলাতন্ত্র চালু করেন। তবে তিনি খুব সাবধানে আধুনিক জীবনব্যবস্থা ও ইসলামি রক্ষণশীলতার মাঝে রেখা টেনে শরিয়াহ আইন সম্প্রসারণ থেকে বিরত থাকেন। ইউএমএনওর বিরোধী দমনের একটি অপ্রত্যাশিত পরিণতি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করে। দেখা যায়, দলটি তার ধর্মনিরপেক্ষ-জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক চেতনা থেকে সরে এসে পিএএসের সঙ্গে ইসলামীকরণের দৌড়ে শামিল হয়ে গেছে। একপর্যায়ে রক্ষণশীলেরাই সেই দৌড়ে এগিয়ে যায়। ২০১৩ সাল নাগাদ দেখা যায়, ৮৬ শতাংশ মালয়েশীয় মুসলিম তাদের দেশের আইনের ভিত্তি হিসেবে শরিয়াহকে গ্রহণ করার পক্ষে মত দিয়েছে।

২০১৩ সালে হারতে হারতে কোনোরকমে জিতে যাওয়া নাজিব পিএএসকে তাদের মূল ঘাঁটি কেলান্তানে (১৯৯০ সালে এখানে আবার নিজেদের জয় ফিরিয়ে এনেছিল পিএএস) শরিয়াহ আইন সম্প্রসারণ করতে দেওয়ার প্রলোভন দেন। সেই প্রলোভনে পিএএস বিরোধী জোট থেকে বেরিয়ে যায় এবং মাহাথিরের নতুন জোট পাকাতান হারাপানের (পিএইচ) ভোটারদের নিজের দিকে ভাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সর্বশেষ নির্বাচনের ফল প্রমাণ করেছে, নাজিব এবং পিএএসের গণনায় ভুল ছিল। কেলান্তান ও তেরেনগানু রাজ্যে পিএএস ভালো করলেও মূল ভূখণ্ডের পশ্চিম উপকূলে দলটি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পিএইচ যে খুব দৃঢ় অবস্থায় আছে তা-ও বলা যাবে না। পিএএস এখনো শক্তিশালী বিরোধী দল এবং শরিয়াহ আইন সম্প্রসারণের জন্য তারা প্রচার চালিয়ে যাবে। এ ছাড়া মাহাথিরের নতুন এই সরকারের সামনে শুধু ইসলামি জাতীয়তাবাদই মূল চ্যালেঞ্জ নয়, ধর্মনিরপেক্ষ বোর্নিও রাজ্যে যেসব আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের উত্থান হয়েছে, সেটা সামাল দেওয়াও তার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।

মোদ্দা কথা, নির্বাচনোত্তর জনপ্রিয়তার কথা সরিয়ে রাখলে দেখা যাবে, পিএইচ যা দেখা যাচ্ছে তার চেয়েও দুর্বল অবস্থানে আছে। যেকোনো সময় শরিক দলগুলো সরে দাঁড়ালে তার সরকার ভেঙে পড়তে পারে।

এরপরও এতে সন্দেহ নেই যে মালয়েশিয়ার গণতন্ত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিস্থলে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশটির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যখন একটি নতুন ভোরের সূচনা হচ্ছে, তখন দেশটিকে কার্যকর বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। মালয়েশিয়ার ইতিহাস বলে, ভালো বিরোধী দল ছাড়া ভালো কোনো সরকারই টিকতে পারেনি। এ কারণে বহুদলীয় গণতন্ত্রের ভিত মজবুত করতে আগে মাহাথিরকে এমন একটি নীতিকাঠামো দাঁড় করাতে হবে, যার আওতায় বিরোধীদের কথা বলা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

ওং চিন-হুয়াত মালয়েশিয়ার পেনাং ইনস্টিটিউটে কর্মরত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী