নির্বাচন ও সংখ্যালঘুদের শঙ্কা

গত শুক্রবার বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের আলোচনা সভায় বক্তারা জাতীয় নির্বাচন এলেই ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা ভয়ভীতিতে 

থাকেন বলে যে অভিমত প্রকাশ করেছেন, তাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ, অতীতে নির্বাচনের সময়, নির্বাচনের আগে ও পরে সংখ্যালঘুদের ওপর নানা রকম হামলা ও হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর দেশব্যাপী যে তাণ্ডব চলে, তা ছিল নজিরবিহীন।

আলোচনা সভায় কোনো কোনো বক্তা বলেছেন, সরকার নিরাপত্তা দিতে না পারলে সংখ্যালঘুরা ভোট বর্জনে বাধ্য হবেন। আমরা আশা করি না, সে রকম পরিস্থিতি তৈরি হবে। তবে এ ব্যাপারে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে কেউ কোনোভাবেই এর সুযোগ নিতে না পারে। একই সঙ্গে এটাও বিবেচনায় রাখা উচিত যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টি শুধু নির্বাচনের সময়েই নয় বরং সব সময়ই এটা বাড়তি গুরুত্ব পাওয়ার বিষয়। জায়গাজমি বা সম্পত্তি দখল থেকে শুরু করে নানা কারণে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিভিন্ন সময়ে বিঘ্নিত হয়। 

সভায় উত্থাপিত নিবন্ধে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বড় রাজনৈতিক দলগুলো সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধছে বলে অভিযোগ এনেছেন। তাঁর এই বক্তব্যকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে জোটবদ্ধ রাজনৈতিক দলকে সহজেই চেনা যায়।

অতীতে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশে সরকারও গঠিত হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করে যদি কোনো রাজনৈতিক দল সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপস করে, তাদের দাবি অনুযায়ী পাঠ্যবই সংশোধন করে, নির্বাচনী রাজনীতিকে বিবেচনায় রেখে তাদের হাতে রাখার চেষ্টা করে, তাহলে সংখ্যালঘুদের আশা-ভরসার শেষ জায়গাটিও থাকে না।

 সাম্প্রদায়িক শক্তি যখন আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতার অংশীদার ছিল তখন সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে বা তাদের ওপর কোনো ধরনের হামলা হলে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি সংখ্যালঘুদের পক্ষে দাঁড়াতে পারে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাদের সহায়তাও কামনা করতে পারে। গেল শতকের নব্বই, বিরানব্বই এবং ২০০১ সালে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে বিবেচিত রাজনৈতিক শক্তি সেই ভূমিকা পালনও করেছে।

কিন্তু অসাম্প্রদায়িক হিসেবে দাবিদার শক্তি ক্ষমতায় থাকার পর যখন রামু, নাসিরনগর ও গোবিন্দগঞ্জের মতো সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে, তখন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তাহীনতা আরও বেড়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। বর্তমান সরকার দাবি করতে পারে যে তারা আক্রান্ত সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও উপাসনালয় পুনর্নির্মাণ করে দিয়েছে। কিন্তু যারা এসব অপরাধ সংঘটিত করেছে, তাদের বিচার হয়েছে কি? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধীরা চিহ্নিত হয়নি এবং কিছু ক্ষেত্রে হয়ে থাকলেও তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে কী বার্তা দেয়? এ ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিরাপত্তার বোধ তৈরি করা যাবে না।

চলতি বছরের শেষে যে জাতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেই নির্বাচনকে সামনে রেখে যাতে কোনো সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সে বিষয়ে সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিকে সজাগ থাকতে হবে। পরিষদের পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে চিহ্নিত কোনো ব্যক্তিকে মনোনয়ন না দেওয়ার যে আহ্বান জানানো হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক দলগুলো সেটি আমলে নেবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সংখ্যালঘুদের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থানকারী ব্যক্তিদের মনোনয়ন না দেয়, সেটি নিঃসন্দেহে জাতীয় রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।