রমাদান ও পিতা-মাতার খেদমত

তাকওয়া অর্জন ও চরিত্র গঠনের জন্য রমাদান ও সিয়াম। রমাদান ও সিয়ামের সঙ্গে ইসলামের অপরাপর বিষয়গুলোর সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। রমাদান হলো প্রশিক্ষণের মাস, যে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর হক ও বান্দার হক পূরণ করতে সক্ষম হয়। রমাদান মাস ইবাদতের মাস; পিতা-মাতার খেদমত অন্যতম ইবাদত। মিরাজ রজনীতে নামাজ ও রোজা ফরজ হয় এবং মিরাজের চৌদ্দটি সিদ্ধান্তের মধ্যে প্রথম হলো আল্লাহর সঙ্গে শরিক না করা ও দ্বিতীয় হলো পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা।

মাতা-পিতার খেদমত না করার কারণে যারা জান্নাত থেকে বঞ্চিত হলো, রাসুল (সা.) তাদের অভিসম্পাত দিয়েছেন। হাদিস শরিফে এসেছে: একদা জুমার দিনে রাসুল (সা.) মিম্বারের প্রথম ধাপে পা রাখলেন এবং বললেন, আমিন! অতঃপর দ্বিতীয় ধাপে পা রাখলেন এবং বললেন, আমিন! তারপর তৃতীয় ধাপে পা রাখলেন এবং বললেন, আমিন! এরপর খুতবা দিলেন ও নামাজ আদায় করলেন। নামাজ শেষে সাহাবায়ে কিরাম প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসুল (সা.) ! আজ যা দেখলাম, তা ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি (আপনি একেক ধাপে পা রেখে, আমিন! আমিন!! আমিন!! বললেন) ; এটা কি কোনো নতুন নিয়ম! নাকি?

নবী করিম (সা.) বললেন: না, এটা নতুন কোনো নিয়ম নয়; বরং আমি মিম্বারে ওঠার সময় হজরত জিবরাইল (আ.) এলেন, আমি যখন মিম্বারের প্রথম ধাপে পা রাখি, তখন হজরত জিবরাইল (আ.) বললেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যারা পিতা-মাতা উভয়কে বা একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পেয়েও তাঁদের খেদমতের মাধ্যমে জান্নাত অর্জন করতে পারল না, তারা ধ্বংস হোক। তখন আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম, আমিন! (তাই হোক)। আমি যখন মিম্বারের দ্বিতীয় ধাপে পা রাখি, তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যারা রমজান পেল, কিন্তু ইবাদতের মাধ্যমে তাদের গুনাহ মাফ করাতে পারল না, তারা ধ্বংস হোক। তখন আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম, আমিন! আমি যখন মিম্বারের তৃতীয় ধাপে পা রাখি, তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যারা আপনার পবিত্র নাম মোবারক (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুনল কিন্তু দরুদ (নবীজির প্রতি শুভকামনা) শরিফ পাঠ করল না, তারা ধ্বংস হোক। তখন আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম, আমিন! (মুসলিম শরিফ)।

মানুষের দায়িত্ব দ্বিবিধ, আল্লাহর হক ও বান্দার হক। মানুষের প্রতি আল্লাহর হক হলো মানুষ একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করবে এবং আল্লাহর সঙ্গে শরিক করবে না। বান্দার হকের মধ্যে প্রথম ও প্রধান হলো পিতা-মাতার হক। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার হক বা অধিকার হলো সন্তান পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে এবং তাঁদের কষ্ট দেবে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন: ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সঙ্গে শরিক কোরো না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো।’ (সুরা-৪ নিসা, আয়াত: ৩৬)। ‘আর আমি নির্দেশ দিয়েছি মানুষকে, তার পিতা-মাতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার জন্য।’ (সুরা-৪৬ আহকাফ, আয়াত: ১৫)। ‘আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি যে তুমি আমার এবং তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমার কাছেই তো ফিরে আসতে হবে।’ (সুরা-৩১ লোকমান, আয়াত: ১৪)।

পিতা-মাতার অবাধ্যতার জন্য যেমন রয়েছে অভিসম্পাত, তেমনি তাঁদের আনুগত্যের জন্য রয়েছে পুরস্কারের ঘোষণা। শুধু তা-ই নয়, তাঁদের প্রতি নেক নজরে তাকালেও হজের সওয়াব পাওয়া যায়। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, যখন কোনো অনুগত সন্তান
স্বীয় পিতা-মাতার প্রতি অনুগ্রহের নজরে দৃষ্টিপাত করে, আল্লাহ তাআলা তার প্রতিটি দৃষ্টির বিনিময়ে একটি করে কবুল হজের সওয়াব দান করেন। (বায়হাকি শরিফ)।

পিতা-মাতার জীবদ্দশায় যেমনভাবে তাঁদের সেবা করা জরুরি, তেমনি তাঁদের ইন্তেকালের পরেও তাঁদের জন্য দোয়া করা দরকার। বনু সালিমা গোত্রের এক ব্যক্তি এসে রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করল, ইয়া রাসুল (সা.), আমার পিতা-মাতা ইন্তেকালের পরেও কি তাঁদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহারের কোনো কিছু দায়িত্ব অবশিষ্ট আছে? তখন নবী করিম (সা.) বললেন, হ্যাঁ, আছে। তা হলো: তাঁদের জন্য দোয়া করা, তাঁদের গুনাহের জন্য তওবা, ইস্তিগফার করা, তাঁদের শরিয়তসম্মত অসিয়তগুলো আদায় করা, তাঁদের আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, তাঁদের বন্ধুবান্ধবদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। এগুলো পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও তাঁদের সঙ্গে উত্তম আচরণের শামিল। (আবু দাউদ শরিফ)। অন্য হাদিসে আছে, ‘পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি, পিতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি।’ (তিরমিজি শরিফ)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম-এর সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail, com