একজন খালিদ শামস

খালিদ শামস
খালিদ শামস

সিভিল অফিসার্স ট্রেনিং একাডেমিতে (কোটা) বনিয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণকালে খালিদ শামসের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়। তিনি ছিলেন কোটার অধ্যক্ষ। তিনি আমাদের সঙ্গে সকালে দৌড়াতেন, ক্লাসে পড়াতেন ও একাডেমি পরিচালনা করতেন। তাঁর সম্পর্কে আরও কিছু বলার আগে প্রশিক্ষণে যোগ দেওয়া আমাদের ব্যাচটি সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন। আমরা ১৯৭৭ সালে পরীক্ষা দিয়ে ১৯৭৯ সালে চাকরিতে যোগদান করি। মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তী টানাপোড়েনে আমাদের সবারই শিক্ষাজীবন থেকে দুই বছর হারিয়ে গেছে। পরীক্ষা অনিয়মিত ও বিলম্বিত হওয়া, মুক্তিযোদ্ধা, মহিলাসহ বিভিন্ন কোটার প্রার্থীদের ভিন্ন বয়সসীমা, প্রভৃতি কারণে প্রশিক্ষণার্থীদের বয়সের বেশ ব্যবধান ছিল। পোড়খাওয়া এমন একটি দলকে প্রশিক্ষণ দেওয়া আসলেই একটা দুরূহ ব্যাপার ছিল।

কোটার শিক্ষাক্রম ছিল দুরূহ ও উচ্চাভিলাষী। নব্য স্বাধীন দেশের আমলাদের একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জের কথা মনে রেখে খালিদ শামস তা প্রণয়ন করেছিলেন। আমরা তখন এর গুরুত্ব অনুধাবন করিনি। তাই সত্যি বলতে কি, কোটার পড়াশোনা, বিভিন্ন ধরাবাঁধা নিয়ম ও শৃঙ্খলা আমাদের অনেকেরই ভালো লাগত না। এটার বহিঃপ্রকাশ ঘটল সমাপনী মেস রজনীর অনুষ্ঠানে। সেখানে শিক্ষানবিশদের কোটার প্রশিক্ষণ বিষয়ে মন্তব্য করার সুযোগ ছিল। আমাদের পক্ষে একজন প্রশিক্ষণার্থী কোটার প্রশিক্ষণের তীব্র সমালোচনা করেন। সকালে পিটি ও বিকেলে খেলার জন্য আমাদের একটা কমলা রঙের গেঞ্জি দেওয়া হয়েছিল, যাতে একাডেমির নাম উত্কীর্ণ ছিল। বারবার ধোয়ার ফলে গেঞ্জিটির রং উঠে গিয়েছিল। কোটার প্রশিক্ষণকে রং ওঠা গেঞ্জির সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, একাডেমি থেকে বের হলে প্রশিক্ষণের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। শ্রোতার সারিতে অন্যদের সঙ্গে খালিদ শামসও বসে ছিলেন। বক্তৃতা শেষে তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য আমাদের প্রায় ৬০ জোড়া চোখ তখন তাঁর ওপর নিবদ্ধ। অবাক হয়ে দেখলাম, তিনি একদম স্বাভাবিক, আমাদের মতো করতালি দিয়ে বক্তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। আমরা আরও চিন্তিত ছিলাম বক্তার কী জানি হয়? উল্লেখ্য, অধ্যক্ষের মূল্যায়নের জন্য ১০০ নম্বর বরাদ্দ ছিল। এটাতে খারাপ করলে আর রক্ষা ছিল না। না, তার কিছুই হয়নি। তিনিও আমাদের মতো সফলভাবে প্রশিক্ষণ শেষ করেন।

১৯৮৩ সাল, তখন আমি ঢাকায় কর্মরত। একদিন সকালে স্যারের ফোন। আপনার ওখানে কী হয়েছে? তার কদিন আগেই আমার দপ্তরে একটা জটিলতার সৃষ্টি হয়। সংবাদপত্রে তা তিনি দেখেছেন। ফোনে বললেন, আমি এখন ইআরডিতে কাজ করি। আপনি একদিন দুপুরে আসেন, একসঙ্গে লাঞ্চ করব এবং কথা বলব। সময় ও দিন স্থির করে তাঁর দপ্তরে গেলাম, তিনি বিস্তারিত শুনলেন। বললেন, আপনার ওখানে চাকরিতে থাকা ঠিক হবে না। যেহেতু আপনি পড়াশোনা পছন্দ করেন, আমি ফয়েজুদ্দিন সাহেবকে (তৎকালীন সংস্থাপনসচিব) অনুরোধ করব আপনাকে বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণকেন্দ্রে পোস্টিং দেওয়ার জন্য। চলে আসব, এমন সময় আমার স্ফীত মধ্যপ্রদেশের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার দৈহিক গড়ন আপনার চাকরির সুনামের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। কোটা ছাড়ার পর দৌড়, খেলাধুলা একদম ছেড়ে দিয়েছেন নাকি? প্রতিদিন দৌড়াবেন। ফেরার পথে ভাবলাম, কেবল একাডেমিতে নয়, কর্মক্ষেত্রেও তিনি প্রতিটি শিক্ষার্থীর সব রকম খবর রাখছেন, তাঁদের সাহায্য করছেন ও প্রয়োজনীয় উপদেশ দিচ্ছেন।

বেশ কিছুদিন পর নিজে থেকেই একদিন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তখন আমরা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইডকলে ‘প্রকল্প অর্থায়ন’ বিষয়ে ১৫টি ক্লাসের একটি কোর্স পরিচালনা করতাম। সরকারি কর্মচারী ও ব্যাংক কর্মকর্তারা এ প্রশিক্ষণ নিতেন। কোর্স শেষে একটা সনদ বিতরণ ও নৈশভোজের অনুষ্ঠান হতো। একবার ভাবলাম, স্যারকে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানাই। প্রশিক্ষণার্থীরা তাঁকে জানবেন এবং তাঁর কথা শুনে উপকৃত হবেন। তাঁকে বললে তিনি রাজি হলেন না। জানালেন, প্রধান অতিথি করার দরকার নেই। তিনি একদিন নিজে আমার অফিসে এসে চা খেয়ে যাবেন। বারবার অনুনয়-বিনয় করলাম। তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না। আমাকে কোর্সের একটা সিলেবাস পাঠাতে বললেন।

আমার ও বব পারার লেখা ফাইন্যান্সিং লার্জ প্রজেক্টস বইটি চীনা ভাষায় অনূদিত হয়েছে-এ সংবাদ খবরের কাগজে দেখে ই-মেইলে আমাকে অভিনন্দিত করে স্যার জানালেন, তাঁর জানামতে, সম্ভবত অতীশ দীপঙ্করের পর এটিই প্রথম কোনো বাংলাদেশি সহলেখকের বই, যা চীনা ভাষায় অনূদিত হলো। তারপর যোগ করলেন, অধ্যাপক ইউনূসের আত্মজীবনীও চীনা ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

ইডকল থেকে ২০০৪ সালে আমরা বায়োগ্যাস প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে স্যারের পরামর্শ নিই। তিনি আমাকে সিরাজগঞ্জের গ্রামীণ মৎস্য প্রকল্প দেখাতে নিয়ে যান। তাঁর সঙ্গে মাইক্রোবাসে যাচ্ছি। শহরের যানজট পার হওয়ার পরই চালককে বললেন, এসিটা বন্ধ করে জানালা খুলে দেন। আর আমাকে বললেন, বাইরে মিষ্টি বাতাস। আপনার অসুবিধা হবে না তো? পরিবেশ সম্পর্কে আজকাল তো অনেক কথাই হয়। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে কতজনই-বা পরিবেশ সংরক্ষণ করেন? যেতে-আসতে অনেক কথা হলো। তাঁর উন্নয়ন ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হলাম। আজকাল ‘ইনক্লুসিভ গ্রোথ’ বলে একটা ভাবনা বহুল প্রচারিত হচ্ছে। খালিদ শামস সত্তরের দশক থেকেই এটা প্র্যাকটিস করেছেন। সিরাজগঞ্জ ও দেশব্যাপী ক্রমশ ক্ষয়মান তাঁতশিল্পের পুনরুজ্জীবন, দেশি ডেইরি শিল্প, মৎস্য চাষের প্রসারের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান, এমনকি কোটা ট্রেনিংয়ের সময় প্রশিক্ষণার্থীদের ভিলেজ স্টাডির জন্য এক মাস গ্রামে অবস্থান বাধ্যতামূলক করার মধ্যে দেশের গণমানুষদের সবাইকে নিয়ে তাঁর উন্নয়নচিন্তা স্পষ্ট।

১৯৯০ সালে তিনি সরকারি চাকরি থেকে আগাম অবসর নিয়ে ড. ইউনূসের আমন্ত্রণে গ্রামীণ ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। তাঁর মতো একজন মেধাবী, নেতৃত্ব গুণসম্পন্ন ও অত্যুচ্চ ভাবমূর্তিসম্পন্ন মানুষ অন্য কারও নির্দেশনায় কাজ করবেন, এটা আমাদের বন্ধুবান্ধবের অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। আমাদের এক বন্ধু এ ব্যাপারে তাঁকে পরোক্ষভাবে জিজ্ঞেসও করেছেন। কিন্তু খালিদ শামসের কখনোই পদ-পদবির কোনো মোহ ছিল না। কাজের সুযোগই ছিল তাঁর কাছে মুখ্য। সুদীর্ঘ ১৪ বছর তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের ভিত্তি দৃঢ় করা ও এর বিকাশের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর গ্রামীণ ব্যাংক নগদ অর্থসংকটে পড়লে তাঁর নেতৃত্বের কারণে প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। ২০০৬ সালে ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করে। গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষে খালিদ শামস পুরস্কারটি গ্রহণ করলে তা যথার্থ হতো এবং পুরস্কারটির মর্যাদা বাড়ত।

প্রচারবিমুখ এ মানুষটিকে অনেকেই চেনেন না, বিশেষ করে আমাদের নতুন প্রজন্ম। তাঁদের জন্য তাঁর জীবনবৃত্তান্ত থেকে দু-একটি তথ্য না দিলেই নয়। খালিদ শামস ওয়াশিংটনে তাঁর স্কুলশিক্ষা-জীবন শেষ করেন। সেখানে তাঁর পিতা অধ্যাপক শামসুল হক (পরবর্তী সময়ে ভাইস চ্যান্সেলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী) শিক্ষা কাউন্সেলর হিসেবে পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ ও তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায়ও তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। কেবল দেশেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তিনি ডিস্টিংকশন-সহকারে জনপ্রশাসন বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন।

খর্বকায় মানুষের ভিড়ে আমাদের এ জনপদে খালিদ শামস একজন উঁচু মানুষ। মেধায়, মনীষায়, সমাজমনস্কতায়, তিক্ততামুক্ত জীবনবোধ, নিরহংকার ও সাদামাটা জীবনাচরণে খালিদ শামস একজন অনুকরণীয় মানুষ। ৭৮ তম জন্মদিনে দেশে-বিদেশে আপনার অসংখ্য গুণমুগ্ধ ছাত্রছাত্রীর পক্ষ থেকে আপনার জন্য সুস্থ ও আনন্দময় শতায়ু কামনা করছি।

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: সাবেক সচিব ও অধ্যাপক