পাহাড়ে খুনোখুনি

৩ মে রাঙামাটির নানিয়ারচরে অস্ত্রধারীদের গুলিতে নিহত হন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি শক্তিমান চাকমা। পরদিন তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়ার পথে সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হন ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দলের আহ্বায়ক তপন জ্যোতি চাকমাসহ আরও পাঁচজন। তারপর ২২ মে খাগড়াছড়ির দিঘিনালায় খুন হন ইউপিডিএফ দলের এক কর্মী। সর্বশেষ গত সোমবার রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার এক গ্রামে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হলেন তিনজন। তাঁরা ইউপিডিএফের কর্মী বলে সংগঠনটি দাবি করেছে। এ নিয়ে গত ডিসেম্বর থেকে পাহাড়ে পাল্টাপাল্টি খুনোখুনিতে প্রাণ হারালেন ২১ জন।

এর আগে জনসংহতি সমিতির নেতা–কর্মীদের হত্যার জন্য সংগঠনটি দায়ী করেছিল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টকে (ইউপিডিএফ)। এখন ইউপিডিএফ অভিযোগ করছে, তাদের কর্মীদের হত্যা করেছে জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা) লোকজন। এই দুটি পাহাড়ি সংগঠন বহু বছর ধরে পরস্পরের নেতা–কর্মীদের হত্যা করে চলেছে বলে তারাই পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করে এবং তারা নিজেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করে।

দুঃখজনক বিষয় হলো, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশ, র‍্যাব ও সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটে চলেছে, কিন্তু এসব হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয় না। মামলা হয়, কিন্তু সেসব মামলার কোনো অগ্রগতি হয় না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে যেন দেশের আইনকানুন কার্যকর নয়।

প্রত্যাশা ছিল, ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ওই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা পাবে। কিন্তু ওই চুক্তির বিষয়ে পার্বত্য জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়, ইউপিডিএফ চুক্তিটির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ফলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন অংশের মধ্যে সংঘাত-সহিংসতায় ২০১৫ সাল পর্যন্ত কয়েক শ মানুষের মৃত্যু ঘটে। ওই বছর পার্বত্য অঞ্চলের তিনটি প্রধান সংগঠনের মধ্যে সমঝোতা হলে সহিংসতা বন্ধ হয়। কিন্তু গত বছরের নভেম্বরে ইউপিডিএফ ভেঙে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে আরেকটি সংগঠনের জন্ম হওয়ার পর ডিসেম্বর থেকে আবার সহিংসতা শুরু হয়।

কিন্তু এই অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। আইন প্রয়োগ ব্যবস্থা সক্রিয় করতে হবে। পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। তবে চলমান বিরোধ-সংঘাতের প্রধান কারণ পাহাড়ি সংগঠনগুলোর মতাদর্শগত ভিন্নতা নয়, বরং এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার পেছনের কারণ মূলত চাঁদাবাজি। এ ছাড়া বৈধ-অবৈধ নানা রকমের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং নিয়মিত ও পেশাদার অপরাধবৃত্তির ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা চলে। এগুলো বন্ধ করা একান্ত জরুরি। সে জন্য আইন প্রয়োগের ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ, সৎ, সক্রিয় ও ফলপ্রসূ করতে হবে। বিবদমান গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টি ও সামগ্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা একান্ত প্রয়োজন। পাহাড়ে রক্তপাত অব্যাহতভাবে চলতে দেওয়া যায় না।