মাতৃমৃত্যু কমার শ্লথগতি

পত্নী বেগম মমতাজ মহলের স্মৃতি অটুট রাখার উদ্দেশ্যে সম্রাট শাহজাহান গড়েছেন অপরূপ তাজমহল। এর পেছনে ছিল গভীর বিয়োগান্ত ঘটনা: মাত্র ৩৮ বছর বয়সে বেগম মমতাজ মহলের মৃত্যু ঘটে ১৪তম সন্তান প্রসবের সময়। বিজ্ঞানীরা বলেন, গর্ভধারণ কোনো রোগব্যাধি বা অসুস্থতা নয়, বরং একটি স্বাভাবিক স্বাস্থ্যগত অবস্থা। সন্তান প্রসবও স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যখন প্রসূতির মৃত্যু হওয়ার কথা নয়।
কিন্তু সপ্তদশ শতকে বেগম মমতাজ মহলের যুগে শুধু ভারতবর্ষে নয়, সারা পৃথিবীতেই সন্তান প্রসবের সময় বিপুলসংখ্যক নারীর মৃত্যু হতো। তার চার শ বছর পরেও এমন অপমৃত্যু বন্ধ হয়নি। ২০১৩ সালেও পৃথিবীতে প্রায় তিন লাখ নারীর মৃত্যু ঘটেছে সন্তান প্রসবের সময়। দুঃখজনক সত্য হলো, এর ৮৫ শতাংশই ঘটে সাব-সাহারা আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। মোট বৈশ্বিক মাতৃমৃত্যুর ২৪ শতাংশ ঘটছে আটটি দেশ নিয়ে গঠিত আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায়।

গর্ভধারণ ও প্রসব–সংক্রান্ত জটিলতায় মৃত্যুকে বলা হয় ‘অ্যাভয়েডেবল ট্র্যাজিডি’। অর্থাৎ এই দুঃখজনক ঘটনা এড়ানো সম্ভব। বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সার্বিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি ঘটে চলেছে, ফলে মাতৃমৃত্যুর হারও উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ১৯৯০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরে কমেছে প্রায় ৬৫ শতাংশ। অবশ্য এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের তুলনায় ভুটান, মালদ্বীপ ও নেপালের অগ্রগতি হয়েছে বেশি, তাদের মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে ৭৫ শতাংশ।

দশক তিনেক আগে মাতৃমৃত্যু কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি ছিল ধীর। তারপরে অবশ্য দ্রুতই এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হয়, মাতৃমৃত্যুর হার প্রায় ৭০ শতাংশ কমে আসে এবং বছরে প্রায় ৫ শতাংশ হারে কমতে থাকে। বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা জরিপ অনুযায়ী, ২০০১ সালে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ২০ শতাংশ, ২০১০ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১৪ শতাংশ। অর্থাৎ এই সময়ে বছরে ৬ শতাংশ হারে কমেছে।
কিন্তু সর্বশেষ জরিপে দেখা যাচ্ছে, তার পরের ছয় বছরে কমেছে মাত্র ১ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১৬ সালে মাতৃমৃত্যুর হার দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশ। এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু কমার গতি এমন শ্লথ হয়ে গেল কেন? এখনো কী কী কারণে মাতৃমৃত্যু ঘটে চলেছে, সে সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ও এ ক্ষেত্রে কর্মরত ব্যক্তিদের নানা পর্যবেক্ষণ আছে। যেমন হাসপাতাল-ক্লিনিক-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নয়, বাসাবাড়িতে প্রশিক্ষিত ধাত্রী ছাড়াই সন্তান প্রসবের সময় প্রসূতির মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকে। প্রসূতি অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে, তাঁর প্রজননস্বাস্থ্য দুর্বল হলে, তাঁর ও পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যসচেতনতার অভাব থাকলে, ঘন ঘন ও অধিক সংখ্যায় সন্তান ধারণ করলেও মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি হয়। কিন্তু এসব সমস্যা ধীরে ধীরে কমে আসছে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসবের হার গত দেড় দশকে ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৭ শতাংশ হয়েছে, কিন্তু এসব সত্ত্বেও মাতৃমৃত্যুর হার কমার গতি শ্লথ হওয়ার কারণ কী? এ বিষয়ে বিশদ গবেষণা প্রয়োজন, মাতৃমৃত্যু আরও কমানোর লক্ষ্যে বাড়তি উদ্যোগ প্রয়োজন।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি যখন বেশ জোরালো ছিল, তখন মাতৃমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এটি স্বাভাবিক, কারণ প্রজননহার, তথা অধিক সন্তান ধারণের প্রবণতা কমলে প্রসূতিমৃত্যুর ঝুঁকিও কমে আসে। সুতরাং পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিতে নতুন বেগ সঞ্চার করা দরকার, দ্বিতীয়ত, মেয়েদের অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে বন্ধ করতে হবে, তৃতীয়ত, প্রশিক্ষিত ধাত্রীর সহায়তায় ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসবের জন্য উৎসাহ সৃষ্টি করতে হবে, নারীর প্রজননস্বাস্থ্য, পুষ্টি পরিস্থিতি ও স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।