মাহাথির হতে চান প্রণব মুখার্জি?

প্রণব মুখার্জি, মাহাথির মোহাম্মদ
প্রণব মুখার্জি, মাহাথির মোহাম্মদ

তবে কি এটা ‘মাহাথির এফেক্ট’? প্রণব মুখার্জিকে কেন্দ্র করে ভারতীয় রাজনীতিতে একেবারে আচমকাই এই প্রশ্ন চরকির মতো ঘুরতে শুরু করেছে। এতটাই যে একটি অতি পরিচিত সংবাদমাধ্যম তো মোটামুটি বলেই দিয়েছে, আসছে বছর প্রণববাবুই হতে পারেন সর্বগ্রাহ্য প্রধানমন্ত্রী!

অথচ ঘোষিতভাবে প্রণববাবু দলীয় রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন যেদিন তিনি রাষ্ট্রপতি হন। তারপর পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার খানিক আগে থেকেই তিনি জানিয়ে দেন, সক্রিয় রাজনীতিতে ফেরার কোনো অভিপ্রায় তাঁর নেই। কিন্তু এই হালে ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন, যার আদর্শে ভারতীয় জনতা পার্টি দীক্ষিত, লালিত ও পালিত, সেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) বার্ষিক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আমন্ত্রণ গ্রহণ করে প্রণববাবু রাজনৈতিক জল্পনার মৌচাকে ঢিল ছুড়েছেন। কেন ও কী কারণে প্রণববাবুর মতো একজন আদ্যন্ত কংগ্রেসিকে আরএসএস প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত করল, কেনইবা প্রণববাবু তা গ্রহণ করলেন, তা নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। প্রণববাবু কিন্তু ‘স্পিকটি নট’। প্রকাশ্যে একটি শব্দও এখনো তিনি উচ্চারণ করেননি।

হতবাক কংগ্রেসও। এতটাই যে ভারতের এই প্রাচীনতম দল আনুষ্ঠানিকভাবে এই বিষয়ে একটি মন্তব্যও করেনি। যদিও এই দলের বিভিন্ন নেতা সরাসরি তাঁর এই সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করে বিবৃতি দিচ্ছেন। কেউ কেউ সমালোচনাও।

এবং এসবের মাঝেই উঠে আসছে ‘মাহাথির এফেক্ট’-এর প্রসঙ্গ। 
মালয়েশীয় রাজনীতিতে হঠাৎই প্রাসঙ্গিক হয়ে গেছেন মাহাথির মোহাম্মদ। ৯২ বছর বয়সে দেশের প্রধানমন্ত্রিত্বের ভার তিনি তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধে। আসছে বছর ভারতে লোকসভার ভোট যখন হবে, প্রণব মুখার্জির বয়স তখন হবে ৮৩। মাহাথিরের মতো তিনিও ‘তরুণ ও তরতাজা’। শরীর, স্বাস্থ্য ও মস্তিষ্ক এখনো সাংঘাতিক সচল। ভারতীয় রাজনীতিতে যে কজন ‘অজাতশত্রু’ রয়েছেন, তিনি সেই তালিকার সবার ওপরে। ইন্দিরা গান্ধী মারা যাওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে নাকি আশা করেছিলেন। সত্য-মিথ্যা এখনো অজানা। ২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হতে না পারার একটা আক্ষেপ অবশ্য তাঁর আছে। যত দিন সক্রিয় রাজনীতি করেছেন, একবারের জন্যও সেই খেদ প্রকাশ করেননি। কিন্তু রাষ্ট্রপতি হয়ে যাওয়ার পর তিন খণ্ডের আত্মজীবনীর ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ার্স’-এ সেই হতাশার কথা লিখে গেছেন। জল্পনার জন্মও ওই থেকে। তাহলে কি তিনিও অনিশ্চিত রাজনৈতিক আবহে সর্বগ্রাহ্য নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশের হাতিয়ার করে তুলতে চাইছেন আরএসএসের আমন্ত্রণকে? হতে চাইছেন ভারতের মাহাথির মোহাম্মদ? আদ্যন্ত রাজনীতিক প্রণববাবু আমন্ত্রণ স্বীকার করার কোনো ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত দেননি। জল্পনার গরু তাই মগডালে উঠে পড়েছে।

না ওঠার কোনো কারণও নেই। প্রথমত, লোকসভা ভোটের বাকি আর মাত্র একটা বছর। দ্বিতীয়ত, নরেন্দ্র মোদির বিজেপির বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হচ্ছে অধিকাংশ বিরোধী দল। তৃতীয়ত, সেই দলের নেতৃত্ব কে দেবেন, তা নিয়ে চলছে একেকজনের মধ্যে কনুই-ঠেলাঠেলি। চতুর্থত, প্রণববাবুই একমাত্র ব্যক্তি, যাঁর বিরুদ্ধাচরণ করার মতো কিছুই নেই। তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস ও কংগ্রেসের সঙ্গে অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময়ের সম্পৃক্ততা। এখন ‘দলহীন’ এই প্রণব মুখার্জি অতএব একমাত্র সর্বজনগ্রাহ্য নেতা হয়ে উঠতে পারেন, এমন যুক্তি-জাল বোনা শুরু হয়ে গেছে। তথ্য যেখানে অনুপস্থিত, জল্পনা সেখানেই প্রাধান্য পায়। আরএসএস কেন প্রণববাবুকে আমন্ত্রণ জানাল, সেই ব্যাখ্যা যেমন নাগপুর থেকে আসেনি, তেমনই কোন যুক্তিতে প্রণববাবু তা গ্রহণ করলেন, দেননি তার ব্যাখ্যাও। অতএব জল্পনার ঘুড়ি উড়ছেই।

সংঘ কেন প্রণববাবুকে আমন্ত্রণ জানাল? জনপ্রিয় ধারণা, কংগ্রেসকে চরম অস্বস্তির মধ্যে ফেলা তার প্রধান কারণ। দ্বিতীয় কারণ, যেসব বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকের মধ্যে আরএসএস নিয়ে ছুঁতমার্গিতা রয়েছে, তাঁদের উদ্দেশে বার্তা দেওয়া। এ কথা বলা যে ওহে দেখো, প্রণব মুখার্জি যদি আসতে পারেন, তাহলে সংঘকে নিয়ে তোমাদের কিসের এত আড়ষ্টতা? কেন এই অস্পৃশ্যতা? তৃতীয়ত, প্রণববাবু অনুষ্ঠানে গেলে এটা বোঝানো যাবে, আরএসএস মোটেই অচ্ছুত নয়। নাগপুর থেকে এই তথ্য ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়েছে যে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ১৯৬৩ সালে প্রজাতন্ত্র দিবসে জওহরলাল নেহরু নিজেই আরএসএস ক্যাডারদের উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সংঘের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী ও জয়প্রকাশ নারায়ণও। ১৯৭৭ সালে বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়ালের উন্মোচন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন স্রষ্টা স্থপতি আরএসএসের শীর্ষ কর্তা একনাথ রানাডে।

রাজনীতির বাইরে চলে গিয়েও ৮২ বছরের এই স্থিতধী ও প্রাজ্ঞ নেতা নাগপুরে গিয়ে সনাতন ভারতীয় মূল্যবোধ, ভারতের বহুত্ববাদ এবং জাতীয়তাবাদ নিয়ে তাঁর মনোভাব প্রকাশ করবেন বলেই অধিকাংশের ধারণা। কংগ্রেসের যেসব নেতা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন (শীলা দীক্ষিত, কুমারী শৈলজা), মনে মনে ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত (সি কে জাফর শরিফ তো রীতিমতো প্রণববাবুকে চিঠি লিখেছেন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে), তাঁরা তাঁদের প্রশ্নের উত্তর পাবেন বলে কংগ্রেসের একাংশের বিশ্বাস। সালমান খুরশিদ কিংবা হরকিষেণলাল ভরদ্বাজ বলেছেন, প্রণববাবু নিশ্চিতভাবেই তাঁর ভাষণে হিন্দুত্ববাদের অসাড়তা বনাম বহুত্ববাদের প্রাসঙ্গিকতার তুলনা টানবেন। সন্দীপ দীক্ষিত বলেছেন, প্রণববাবুকে আমন্ত্রণ জানানোর মধ্য দিয়ে সংঘ পরিবার এটাই বুঝিয়ে দিল, তাদের সম্পর্কে প্রণববাবুর মনোভাবকে তারা গুরুত্ব নিচ্ছে। পঁচিশ-তিরিশ বছর ধরে কংগ্রেসের যত অধিবেশন হয়েছে, যত প্রস্তাব পাস হয়েছে, সবকিছুর খসড়া তৈরির দায়িত্বে ছিলেন প্রণব মুখার্জিই। প্রতিটি প্রস্তাবেই বিজেপির জাতীয়তাবাদ ও হিন্দুত্ববাদ সমালোচিত হয়েছে।

সংঘের রাজনীতির বিরোধিতা করলেও ব্যক্তিগত স্তরে প্রণববাবুর সঙ্গে সংঘের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সদ্ভাব বরাবরের। প্রণববাবু রাষ্ট্রপতি থাকাকালে সংঘপ্রধান মোহন ভাগবত তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন। মধ্যাহ্নভোজও করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার মিরিটিতে গ্রামের বাড়ির দুর্গাপুজোয় হাজির থেকেছেন সংঘের বড় নেতারা। ১৯৭৩-৯৩ সাল পর্যন্ত সংঘপ্রধান থাকা মধুকর দত্তাত্রেয় দেওরস দিল্লিতে প্রণববাবুর বাসভবনে একাধিকবার এসেছেন। তাঁর বাড়িতে একাধিকবার গেছেন সংঘকর্তা রাজেন্দ্র সিং, কে সুদর্শন, গোবিন্দাচার্যরাও। প্রণববাবুর ঘনিষ্ঠ মহলের মতে, মেলামেশা সত্ত্বেও প্রবীণ এই রাজনীতিক ধর্মনিরপেক্ষতা, সহিষ্ণুতা ও বহুত্ববাদের আদর্শ থেকে কখনো সরে আসেননি। অতএব তাঁকে ঘিরে জল্পনা অনর্থক।

হতেই পারে। কিন্তু তাই বলে ভোটের এই কড়া নাড়ার সময় ‘মাহাথির এফেক্ট’-কে কেউ উড়িয়েও দিতে পারছে না।