সৌরবিদ্যুৎও আমদানির উদ্দেশ্য কী?

ভারত থেকে সৌরবিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্তে বাংলাদেশে তৈরি হতে থাকা নিজস্ব ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতি হবে কি না এবং সেই সঙ্গে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাবে কি না, তা নিয়ে ভাবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কোনো কিছুর ঘাটতি পূরণে আমদানিই একমাত্র সমাধান নয়, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমাধান তালিকায় এটি হচ্ছে সর্বশেষ এক উপায়। সংকটের সমাধান হিসেবে আমদানি করার সিদ্ধান্ত নেওয়াই সবচেয়ে সহজ, বিপরীতে দূরদর্শী নীতির বাস্তবায়ন ঘটিয়ে উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কাজ করা চ্যালেঞ্জিং। আমদানির ফরমাশ পেলেই চলে আসে ‘ফিনিশড প্রোডাক্ট’, বেড়ে যায় দাম। আর নিজস্ব উৎপাদনব্যবস্থা গড়ে তুললে গড়ে ওঠে গোটা ইন্ডাস্ট্রি, সেই সঙ্গে কমতে থাকে দাম।

মাত্র দেড় দশকেরও কম সময়ে সারা দেশে ৪৫ লাখেরও বেশি সোলার হোম সিস্টেমের ব্যবহার শুরু করার নজির পৃথিবীর আর কোথাও নেই। যখন এই সিস্টেমের দাম ছিল চড়া, ব্যাটারির মেয়াদ ছিল ক্ষণস্থায়ী, তখনো মানুষ রাতের বেলা মাত্র তিন থেকে চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রয়োজনে সোলার হোম সিস্টেম কিনতে পয়সা খরচ করেছে। আর এখন যখন বাজারে দীর্ঘস্থায়ী লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি চলে এসেছে, প্রতি ইউনিট সৌরবিদ্যুতের দাম গত ৭ বছরে ৭২ শতাংশ কমে গেছে, ভারতে মাত্র সাড়ে তিন টাকা খরচে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড তৈরি হয়েছে, তখন ঠিক কী কারণে বাংলাদেশে নিজস্ব উৎপাদনব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা না করেই আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে হবে, সেটা একটা জরুরি প্রশ্ন।

গত মাসে নয়াদিল্লিতে আন্তর্জাতিক জ্বালানিবিষয়ক সভায় অংশগ্রহণকালে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ভারত থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন (ঢাকা ট্রিবিউন, ১৮ এপ্রিল, ২০১৮)। কিন্তু এই আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সস্তা বিকল্প উপায় খুঁজে দেখা হয়েছে কি না, কিংবা এটি বাংলাদেশে সোলার প্যানেল উৎপাদন আর বিতরণ ব্যবসার ক্ষতি করবে কি না বা আমদানি করা বিদ্যুতের বাড়তি দাম পরিশোধের কারণে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাবে কি না, সেসব প্রশ্ন এখন পর্যন্ত অমীমাংসিত।

অবশ্য আমদানির এই হুজুগ হঠাৎ করেই তৈরি হয়নি। এর পেছনে বিদ্যুৎ খাতের সর্বশেষ নীতিমালার (পিএসএমপি-২০১৬) জোরালো সমর্থন রয়েছে। এই নীতিমালায় কমতে থাকা সৌর ও বায়ুবিদ্যুতের দাম ভবিষ্যতে আরও কমে যাওয়ার হিসাব উল্লেখ করা আছে। এরপরও নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ২০৪১ সালের মধ্যে কী কারণে মাত্র ১৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটার ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

দেশ-বিদেশের প্রকাশিত গবেষণাপত্রগুলোয় সৌর, বায়ু ও বর্জ্যবিদ্যুৎ দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বাংলাদেশের অসীম সম্ভাবনার দিকগুলো উন্মোচিত হচ্ছে। সেহেতু দেশের ভেতরে উদ্যোগের পরিধি না বাড়িয়ে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরের গুজরাট ও রাজস্থান থেকে সৌরবিদ্যুৎ আমদানির তোড়জোড়ে লাভের গুড় শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের পাতে জুটবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

সর্বোচ্চ সূর্যালোকপ্রাপ্তির ক্রমতালিকায় বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে একটি। এত দিন পর্যন্ত সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে জমির পরিমাণকে বড় বাঁধা হিসেবে দেখে আসা হলেও বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থায় সোলার শেয়ারিং, মিনি গ্রিড, মাইক্রো গ্রিড এবং ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হওয়ায় কৃষিজমি নষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগই এখন আর নেই। বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের প্রসারে প্রকৃতই কত জমি প্রয়োজন হবে, সে হিসাব করার পাশাপাশি রেলওয়ের কী পরিমাণ জমি অবৈধ দখলে চলে গেছে, নদী ভরাট করে কী পরিমাণ জমিতে দালানকোঠা উঠেছে, রাষ্ট্রের কী পরিমাণ জমি ব্যক্তিগত সম্পত্তির দলিলে উঠে গেছে, সে হিসাবও করা জরুরি। যেখানে বাংলাদেশের শুধু অকৃষি খাসজমি ব্যবহার করেই কমপক্ষে পাঁচ লাখ মেগাওয়াট ক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব, সেখানে কোনো যুক্তিতে ভারত থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে, তা খুঁজে দেখা জরুরি।

ভারত ২০২২ সালের মধ্যেই ১ লাখ ৬০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ স্থাপন করার নীতি ঘোষণা করেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির সস্তা বিদ্যুতের কারণে এরই মাঝে সেখানে ১৪ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করে দেওয়া হয়েছে (দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট, ২৩ মে, ২০১৭)। চালু থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও সর্বোচ্চটুকু উৎপাদন করতে পারছে না আর অপচয় কমাতে ২০২৭ সালের মধ্যেই ৫০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ সংস্থা (ফোর্বস, ৩০ জানুয়ারি, ২০১৮)। এভাবে গড়ে উঠতে থাকা নিজস্ব এই বিশাল ইন্ডাস্ট্রির চুঁইয়ে পড়া বাড়তি উৎপাদন বিক্রি করতে কে না চাইবে! কিন্তু বাংলাদেশ যদি এই আমদানির বাজার থেকে নিজেকে উন্মুক্ত করে, তবে নিশ্চিতভাবেই কমতে থাকবে নিজস্ব গবেষণা, উদ্ভাবন আর সস্তা বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ।

এসব কারণেই সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের উপায় হিসেবে সম্ভাবনার জায়গাগুলোর দিকে প্রথমে নজর দিতে হবে। আলাপ-আলোচনা আর গবেষণার সুযোগ তৈরি করতে হবে। সস্তা ও পরিবেশসম্মত উপায়ে বিদ্যুৎ পেতে চাইলে আমদানির টোটকা সমাধানে আখেরে কোনো লাভ হবে না।

মওদুদ রহমান: প্রকৌশলী, গবেষক।
[email protected]