দ্বিগুণ বেড়েও মাত্র ৫০ কোটি টাকা

ক্রীড়াঙ্গনে বিনিয়োগ করলে যে ফল মেলে, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ মেয়েদের ফুটবলে সাফল্য। ছবি: প্রথম আলো
ক্রীড়াঙ্গনে বিনিয়োগ করলে যে ফল মেলে, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ মেয়েদের ফুটবলে সাফল্য। ছবি: প্রথম আলো

যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদার সেদিন (গত বৃহস্পতিবার) বলছিলেন, থোক বরাদ্দ দিয়ে ক্রীড়াঙ্গন চালাতে গেলে অনেক সমস্যা। থোক বরাদ্দের প্রসঙ্গটি আসে ক্রীড়া মন্ত্রণালয় পরিকল্পিত জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল টুর্নামেন্টের জন্য। প্রায় এক বছর ধরে এই টুর্নামেন্টটি করার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে অবশেষে সেটি চূড়ান্ত করতে পেরেছে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। রাজস্ব খাতে এটির বাজেট অনুমোদিত হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে এটির নামকরণও অনুমোদন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। আগামী অর্থবছর, অর্থাৎ জুলাই ২০১৮ থেকে জুন ২০১৯-এর মধ্যেই হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোল্ড কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট। অনূর্ধ্ব-১৭ বছর বয়সী ছেলে ও মেয়েদের এই প্রতিযোগিতার প্রথম বছর মাঠে গড়াবে শুধু ছেলেদেরটি, যেটির বাজেট ১৪ কোটি ৫২ লাখ ১৬ হাজার টাকা।

বাংলাদেশের খেলাধুলায় বাজেট থাকে খুবই কম। পাঁচ বছরের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ক্রীড়া মন্ত্রণালয় দেখেছে, ক্রীড়া খাতে গড় বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের মাত্র দশমিক ৩ শতাংশ অর্থ। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের বাজেট ছিল ১৪৪১ কোটি টাকা। যার মধ্যে যুবর জন্য ছিল ৯০০ কোটি টাকার বেশি, ক্রীড়ায় ৫০০ কোটি টাকার বেশি। এই বাজেটের বড় অংশটাই আবার অনুন্নয়ন খাতে, অর্থাৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ইত্যাদির পেছনে ব্যয় হয়। প্রতিবছর বাজেট বৃদ্ধির ন্যূনতম সীমা ৮-১০ শতাংশ। কিন্তু এবার সেটি ছাপিয়ে ১৩ শতাংশ বেড়ে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের বাজেট ১৫২০-১৫২১ কোটি টাকা হচ্ছে বলে জোরালো ধারণা।

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের বাজেটে মাঠের ক্রীড়া কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ থাকে অতি নগণ্য। গতবার ছিল ২৫ কোটি টাকা, আগামী বছর ঠিক দ্বিগুণ বেড়ে হচ্ছে ৫০ কোটি। এবারের বাজেটের অনন্য দিক ক্রীড়া বাজেট নামে আলাদাভাবে এই ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ। এই টাকা বিভিন্ন জাতীয় ফেডারেশনকে দেওয়া হবে খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য। বিগত বছরগুলোতে প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতার জন্য টাকা আসত থোক বরাদ্দ থেকে।
মাঠের খেলাধুলার বাজেট বাড়ানোর জন্য ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবার বিশেষ উদ্যোগী ছিল। এ জন্য ৩৪টি জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশন ও ১৪টি জাতীয় ক্রীড়া অ্যাসোসিয়েশনের কাছে আগামী পাঁচ বছরের জন্য বাজেট চাওয়া হয়। বারবার তাগাদা দিয়েও অবশ্য মন্ত্রণালয় সাড়া পেয়েছে মোট ৩৯টি ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের। কোনো ফেডারেশন সাড়া দিয়েছে প্রবল উচ্ছ্বাসে। এমন এমন ফেডারেশন আছে, যাদের প্রতিযোগিতা আয়োজন ও খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ বাবদ বছরে ২০ লাখ টাকা ব্যয়ের সামর্থ্য বা সুযোগ নেই, তারাই চেয়ে বসে কোটি টাকার বেশি। খো খোর মতো ফেডারেশন এক বছরে চায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা, নতুন ফেডারেশন রাগবির চাওয়া ৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। প্রথম বছর সাড়ে ২০ কোটি টাকা চেয়ে পাঁচ বছরে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের দাবি প্রায় ১২০ কোটি টাকা।

কামান চাইলে বন্দুক পাওয়া যেতেও পারে-এই আশাতেই উদ্দীপ্ত অপ্রধান কিছু ফেডারেশন। আর এতেই বার্ষিক চাহিদা গিয়ে ঠেকে ১২০ কোটি টাকায়। কিন্তু আশার বেলুন চুপসে দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিকভাবে জানিয়ে দেয়, এটি কমাতে হবে। কমিয়ে করা হয় ৬৫ কোটি টাকা। সেটিও শেষ পর্যন্ত অনুমোদিত হচ্ছে না। ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, অনুমোদিত হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। এটিও অবশ্য কম নয়, আগেরবারের চেয়ে ঠিক দ্বিগুণ। অর্থ মন্ত্রণালয় অবশ্য আশ্বাস দিয়েছে, পরবর্তী বাজেটে এটি অনেক বাড়বে। অবশ্য সঙ্গে একটা শর্ত জুড়ে দিয়েছে, বাজেট বাড়বে ঠিক আছে, কিন্তু একটি বাজেট তদারকি কাঠামো গড়তে হবে, যাতে যথেচ্ছ ব্যয় না হয়।

বিশেষ ক্রীড়া বাজেট হচ্ছে জেনে যেসব ফেডারেশন বা অ্যাসোসিয়েশন আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে কয়েক গুণ বাড়িয়ে ধরেছিল বাজেট, তাদের জন্য দুঃসংবাদ। এই ৫০ কোটি টাকাও বরাদ্দ হবে অগ্রাধিকারভিত্তিক। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্যের সম্ভাবনা এবং নিয়মিত প্রতিযোগিতা-প্রশিক্ষণ যেসব ফেডারেশনে হয়, তাদেরই বরাদ্দ বাড়বে। যেমন শুটিং, ফুটবল, আর্চারি, ভারোত্তোলন ইত্যাদি। ক্রিকেট এখানে একেবারেই আলাদা। ক্রিকেট বোর্ড তো মন্ত্রণালয়ের কাছে বাজেটই পেশ করেনি। সেটির দরকারও হয়তো তাদের নেই। বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনী ক্রীড়া ফেডারেশনের টিভিস্বত্ব বা আইসিসির লভ্যাংশ থেকে আয় অনেক। অনেক দুস্থ ক্রীড়া ফেডারেশনকে বিসিবি আর্থিক সহায়তাই দিতে পারে। মাঝেমধ্যে দেয়ও।

ক্রীড়া বাজেট দ্বিগুণ বাড়ার পরও তা হচ্ছে মাত্র ৫০ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে সম্ভ্রম ও সমীহ অর্জন করার জন্য এই টাকা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। ক্রীড়াঙ্গনে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে উন্নত দেশগুলো অর্থ বিনিয়োগ করে সাফল্য কেনে। সেদিন কয়েকজন সাবেক ফুটবলার বলছিলেন, বদলে যাওয়া এই বিশ্বে কার্পণ্য করে খেলাধুলা হয় না। সরকারকে বিষয়টি বুঝতে হবে।

খাঁটি কথা। আগামী জাতীয় বাজেট যদি সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকার হয়, আর এর যদি মাত্র ১ শতাংশ যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ হয়, সেটিরই পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। এর অর্ধেক, অর্থাৎ আধা শতাংশ বরাদ্দ রাখলেও বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন চিরকালের হামাগুড়ি দেওয়া অবস্থা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে চাইবে। হয়তো একটু দৌড়াতেই ইচ্ছা করবে।

পবিত্র কুন্ডু: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি