ফেসবুক বন্ধুতে কি বন্ধুত্বের তৃষ্ণা মেটে?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা’ প্রবন্ধে খুব বিচক্ষণতার সঙ্গে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বন্ধুত্ব আটপৌরে। বন্ধুত্বের আটপৌরে কাপড়ের দুই-এক জায়গায় ছেঁড়া থাকিলেও চলে, ঈষৎ ময়লা হইলেও হানি নাই, হাঁটুর নিচে না পৌঁছিলেও পরিতে বারণ নাই। গায়ে দিয়া আরাম পাইলেই হইল। বন্ধু আমাদেরই মত দোষে-গুণে জড়িত মর্ত্যের মানুষ হইয়া থাক, এই আবশ্যক। আমরা বন্ধুর নিকট হইতে মমতা চাই, সমবেদনা চাই, সাহায্য চাই ও সেই জন্যই বন্ধুত্ব চাই।’

রবীন্দ্রনাথের সময় ফেসবুক ছিল না। জানি না রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে তিনি কীভাবে আজকের ফেসবুকের বন্ধুত্বকে সংজ্ঞায়িত করতেন। আজকালকার ফেসবুকের বন্ধুত্ব রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আটপৌরে নয় মোটেই; বরং এটি দামি মোড়কের আবরণে সুনিপুণভাবে আবৃত; যে আবরণ আড়াল করে দেয় বন্ধুত্বের সব স্বাভাবিকতা। বন্ধুদের আড্ডায় আজ আড্ডা গুরুত্বপূর্ণ না হয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে অংশগ্রহণকারীদের পোশাক, আড্ডাস্থল, খাবারের মেনু ইত্যাদি। কারণ এসবই আজকাল ফেসবুকের ওয়ালে প্রদর্শনের বিষয়বস্তু। সামনাসামনি অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশও আজ ছবি পোস্ট, লাইক, কমেন্টস আর লাইভের চর্চায় ব্যাহত। সেলফি স্টিক হাতে আজ আমরা প্রস্তুত আড্ডায় যোগ দেওয়ার জন্য। এই আয়োজনগুলো যত নিখুঁতভাবে করা যায়, কৃতিত্ব ততই বেশি। ফেসবুক অনেকের কাছেই সুখী জীবন প্রদর্শনের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। তাই এতে খুঁত রাখা চলে না। এই আয়োজনে যিনি যত নিপুণভাবে নিজেকে প্রদর্শন করতে পারেন, তিনি তত বড় পরিচালক। বাস্তব জীবনের সম্পর্কের নানা টানাপোড়েন নিপুণভাবে ঢাকা পড়ে যায় ফেসবুকের চকচকে দেয়ালে। জন্মদিনে এখন আমরা বাস্তব কেকের বদলে ভার্চ্যুয়াল কেক আর অভিনন্দনেই খুশি। অন্যদিকে রাত বারোটায় পরিজনদের হৃদয়ের উষ্ণতা মাখানো শুভকামনা জানানোর স্বাভাবিক আয়োজন গৌণ হয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে পরিপাটি পোশাক আর মেকআপের আড়ালে পরিজনদের দর্শনীয় কেক কাটার মেকি উৎসব। সে আয়োজন যতই বাস্তবতাবর্জিত হোক না কেন, সেই অবাস্তবতাই চলতি বাস্তবতা। সেই উদ্‌যাপনের প্রযোজনায় সামান্যতম কার্পণ্য নেই আজ আমাদের। এ যেন সুখী সুখী মুখে সবার মাঝে অতৃপ্তির অসুখ ছড়ানোর এক সংক্রামক ব্যাধি। সবাই ছুটেছে আজ প্রকৃত সুখের খোঁজ না করে মুখোশ সুখের সন্ধানে।

নাটকীয়তা আর কৃত্রিমতায় ভরা আজকের ফেসবুকের দুনিয়া জানতে দেয় না সত্যিকার অর্থে কে আমাদের বন্ধু আর কে শত্রু। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘বন্ধুত্ব বলিতে তিনটি পদার্থ বুঝায়। দুই জন ব্যক্তি ও একটি জগৎ।’ কিন্তু আমাদের ফেসবুকের জগৎ হাজার হাজার বন্ধুতে পরিপূর্ণ। তাদের অনেকেই আমাদের অদেখা, অচেনা। প্রশ্ন আসে মনে, যে ব্যক্তিটি কখনো আমাদের দৃষ্টির সামনেই আসেনি, সে আমাদের বন্ধু হয় কী করে! জীবনে হয়তো একবার দেখা কিংবা সম্পূর্ণ অদেখা মানুষটিও ফেসবুকের বদৌলতে আজ আমাদের বন্ধু। একেই নাকি বলে ভার্চ্যুয়াল বন্ধুত্ব! ছোটবেলায় শুনেছি বন্ধু দেখে নাকি মানুষ চেনা যায়। কিন্তু পাঁচ হাজার বন্ধু নিয়ে যে ব্যক্তিটি সগৌরবে ফেসবুকে বিচরণ করছেন, কোন কৌশলে, কোন মানদণ্ডে কিংবা কতজন বন্ধুকে দেখে তার সম্পর্কে আমরা ধারণা লাভ করতে পারব; সেই প্রশ্নটি প্রায়ই ঘুরপাক খায় মনে। সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘বন্ধুত্ব গড়তে ধীরগতির হও। কিন্তু বন্ধুত্ব হয়ে গেলে প্রতিদিনই তার চর্চা করো।’ কিন্তু আজকের ফেসবুকের কল্যাণে আমাদের বন্ধু বানানোর গতি বুঝি রকেটের গতিকেও হার মানায়। আর এই ক্রমবর্ধমান বন্ধুত্বের সত্যিকার পরিচর্যা কি আদৌ সম্ভব আমাদের বাস্তব জীবনে!

তাই আজ চিন্তা করার সময় এসেছে আমরা আসলে কী চাই: বন্ধু নাকি বন্ধুত্ব? ফেসবুকের একজন বন্ধু সত্যিকার অর্থেই বন্ধুত্বের জন্য প্রয়োজনীয় মনের খোরাক মেটাতে সক্ষম কি না, তা তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। ফেসবুকীয় বন্ধু আর বন্ধুত্বের গোলকধাঁধায় আমরা হারিয়ে ফেলছি না তো বন্ধুত্বের প্রকৃত সৌন্দর্য, ঔদার্য আর শক্তি! এই বিষয়গুলো মিলিয়ে না নিতে পারলে সম্পর্কের বিভিন্ন আবর্তে আমরা হারিয়ে ফেলতে পারি নিজেদের। হেলেন কেলার বলেছিলেন, ‘অন্ধকারে একজন বন্ধুর সঙ্গে হাঁটা আলোতে একা হাঁটার চেয়ে ভালো।’ ফেসবুকের বন্ধুরা রবিঠাকুরের ভাষায় ‘মর্ত্যের মানুষ’ হতে চায় না আজকাল। তারা কেবলই দিন দিন হয়ে উঠছে অতি মানব কিংবা সুখ নামক বাতাসে ঠাসা, রং মাখা, সং সাজা একেকটি গ্যাসবেলুন। এই গ্যাসবেলুন সামান্য খোঁচায় চুপসে যায়, বিবর্ণ ও শ্রীহীন হয়ে পড়ে সামান্য খোঁচায়, তাপে বা চাপে তা বিস্ফোরিত হয়।

একজন ভালো বন্ধু মানুষের জীবনের অমূল্য সম্পদ। তাই ফেসবুকে বন্ধু নির্বাচনে আর বন্ধুত্ব রক্ষায় প্রয়োজন সচেতনতা ও দায়িত্বশীল আচরণ। ফেসবুকসহ যেকোনো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বন্ধু ও বন্ধুত্ব সম্পর্কে অস্বচ্ছ ধারণা ও উদাসীনতা আমাদের জন্য হতে পারে চরম সর্বনাশের কারণ। আমরা যেন আমাদের সামান্যতম অসচেতনতার কারণে বন্ধুত্ব নামের এই পবিত্র সম্পর্কটির মর্যাদা হারিয়ে না ফেলি। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আমাদের মূল লক্ষ্য হোক সত্যিকারের বন্ধুত্ব রচনা, মেকি বন্ধু তৈরি করা নয়।

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক।
[email protected]