নির্বাচন কমিশনে ভিন্নমত

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহকারী প্রেস সচিবের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মাহবুব তালুকদারের নোট অব ডিসেন্ট সম্ভবত নির্বাচন কমিশনের ইতিহাসের প্রথম ঘটনা। এর আগে এ টি এম শামসুল হুদা ও কাজী রকিবউদ্দীন কমিশনের আমলে ভিন্নমত দেওয়া-বিষয়ক গুঞ্জন শোনা গেলেও তা বাস্তবে রূপ নেয়নি। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন দুটি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিতে উদ্যোগী হলেও শেষ পর্যন্ত তা আর দেননি। শামসুল হুদা কমিশন অবশ্য তা মেনে নিয়েছিল। ভারতের নির্বাচন কমিশনেও কমিশনের সদস্যসংখ্যা বাড়ানোর পরে এই সমস্যা দেখা গিয়েছিল। বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে গড়ালে তাঁরা বলে দিলেন, ইসি একটি সমন্বিত বডি হিসেবে কাজ করবে। আর সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। অনেক পরে আমাদের উচ্চ আদালতও ওই রায়ের বরাতে একই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। কিন্তু দেশে গণতান্ত্রিক ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ যখন যথেষ্ট সংকুচিত হয়ে পড়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছিল, তখন একজন মাহবুব তালুকদার তবু একটি উদাহরণ তৈরি করলেন। শুনেছি, আরও একজন সাংসদদের এমন সুবিধা প্রদানের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু তাঁরা তালুকদারের মতো সাহসী হননি।
সামগ্রিকভাবে নুরুল হুদা কমিশন অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে তৈরি করা হলেও এ পর্যন্ত তারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হয়ে ওঠা বা বিবেচিত হওয়ার অবস্থা থেকে অনেক দূরে রয়েছে। পরিহাস হলো, যে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শ্রীহীনতার জন্য আমরা অনেকে তাদের নাম মুখে নিতে চাই না, সেখানে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সরকার বদলের ধারা ফিরে এসেছে। সামরিক বাহিনী পেছন থেকে কলকাঠি নাড়লেও তারা বিচার বিভাগের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী অপসারণের ভূমিকম্প সামলে নিয়েছে। এমনকি সব থেকে যা লক্ষণীয় তা হলো, পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির ধকলও কাটিয়ে উঠেছে তারা। নওয়াজ শরিফের উত্তরসূরি তাঁর দল থেকে এসেছেন, তাঁর পরিবার থেকে নয়। সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা মানুষেরা রাতারাতি প্রধানমন্ত্রী পদে আসছেন। ওয়েস্টমিনস্টার ধাঁচ, যার ভিত্তিতে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সংবিধান তৈরি করা হয়েছিল, সেই ধাঁচটি এখন পাকিস্তান সাফল্যের সঙ্গে অনুসরণ করছে।
৩১ মে পাকিস্তানের পার্লামেন্টের মেয়াদ পূরণ হচ্ছে। ওই দিনই সংসদটি আপনা–আপনি ভেঙে যাবে। ২৫ জুলাই তারা নির্বাচনে যাবে। সব থেকে বড় সাফল্য, ২৮ মে ক্ষমতাসীন মুসলিম লিগ ও বিরোধী দল সমঝোতার মাধ্যমে সাবেক প্রধান বিচারপতি নাসিরুল মুলককে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছে। ডেমোক্রেসি রিপোর্টিং ইন্টারন্যাশনালের (ডিআরআই) বরাতে ডন দাবি করেছে, পাকিস্তানই এই মুহূর্তে বিশ্বের একমাত্র দেশ, যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করছে। তাদের এই দাবি সম্ভবত ঠিক নয়, কারণ গ্রিসের সংবিধানেও নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিধান আছে।
তবে পাকিস্তানই একমাত্র দেশ, যেখানে সরকারি ও বিরোধী দল সব থেকে বেশিবার অরাজনৈতিক এবং অনির্বাচিত ব্যক্তিদের সমঝোতাক্রমে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়েছে। ১৯৯০ সালে গোলাম মোস্তফা জাতই, ১৯৯৩ সালে মির বালাক শেখ মাজারি ও মইন আহমেদ কোরেশি, ১৯৯৬ সালে মালিক মিরাজ খালিদ, ২০০৭ সালে মুহাম্মদ মিয়া সুমরো এবং ২০১৩ সালে মির হাজার খান খুসো (একজন সাবেক বিচারপতি) তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। যদি বলা হয়, এর পেছনে সামরিক বাহিনী কলকাঠি নেড়েছে, তাহলে এটা প্রতীয়মান হয় যে পাকিস্তান সামরিক শাসনের একটি ধ্রুপদি রাষ্ট্র হয়েও বেসামরিক মুখকে সামনে আনার চেষ্টায় কিছুটা সাফল্য দেখিয়েছে।
পাকিস্তানে একাদিক্রমে কয়েকটি মেয়াদে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের উদাহরণ তৈরি করতে পারে, তা একসময় অনেক নির্বাচন ও গণতন্ত্র-বোদ্ধার ধারণার বাইরে ছিল। ২০১২ সালের আগে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী বাছাইয়ে প্রেসিডেন্টের বিশেষ এখতিয়ার ছিল। সেখানেও আমরা দেখব, পাকিস্তানি দলীয় প্রেসিডেন্টরা দলের বাইরে যেতে পেরেছেন। ২০১২ সালে সংবিধান সংশোধন করে বলা হলো যে প্রেসিডেন্টের এই বিশেষ এখতিয়ার থাকবে না। তখন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার ‘সমঝোতাক্রমে’ প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ের ক্ষমতা দেওয়ার পর এই ধারণা খুব স্বাভাবিক ছিল যে এটা কাজে দেবে না। কিন্তু সেই আশঙ্কা এখন পর্যন্ত অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। সমঝোতা না হলে কী হবে, সেই বিকল্পও সংবিধান রেখেছে। এমন পরিস্থিতিতে বিষয়টি যাবে সমসদস্যসংখ্যক সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির কাছে। তারা ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে তারা পাঠাবে ইসির কাছে, যাদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী উপহার দিতে হবে। এরপর কেন্দ্রে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী এবং প্রদেশে তত্ত্বাবধায়ক মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শে নয়া মন্ত্রিসভা কাজ শুরু করে দেবে।
এ রকম একটি ব্যবস্থা পাকিস্তানে টিকে যেতে পারলে কেন তা অন্যত্র কাজ করবে না, তার উত্তর হয়তো বিশেষজ্ঞদের জানা আছে। তবে পাকিস্তান দেখাচ্ছে, একটি শক্তিশালী এবং স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম ইসির কোনো বিকল্প নেই। ২০১২ সালে সংবিধান সংশোধনের পর ২০১৩ সালে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে পাকিস্তানি ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল কিন্তু সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছিল। তখন ইসিই ত্রাতার ভূমিকায় নামে এবং বিচারপতি খোসোর ব্যাপারে সংসদীয় কমিটি সমঝোতায় আসতে ব্যর্থ হলেও ইসি তা স্থির করে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ইসি যখন সাংসদদের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়ার বিষয়ে আচরণবিধি সংশোধন করেছে, তখন পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের আচরণবিধি অনুযায়ী গোটা পাকিস্তানের সকল পর্যায়ে শুধু মন্ত্রীরা নন, তাঁদের সন্তান, পোষ্যরা এবং তাঁদের অধীনে থাকা সকল পর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রচারণায় শামিল হতে পারেন না।
আসল কথা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক কিংবা দলীয় সরকার—যার অধীনেই হোক নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইসিই সর্ব অগ্রগণ্য। ২৮ মে ডন-এ আহমেদ বিলাল মেহবুব ‘আমাদের কি সত্যিই কেয়ারটেকার কেবিনেট দরকার’ শীর্ষক নিবন্ধে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ টেনেছেন। তিনি অনির্বাচিত ব্যক্তিদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আনার বিরোধী। বলেছেন, উল্টো ফল দেওয়ায় বাংলাদেশ ২০১১ সালে এই বিধান বিলোপ করেছে। তবে মেহবুব স্বীকার করেছেন যে ইসির ভূমিকার কারণেই ২০১৩ সালে অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে পাকিস্তান। আবার এ-ও ঠিক যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানাবলি ১৮তম সংশোধনীতে কার্যকর করার পর এর কিছু অস্পষ্টতা থাকায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে ঠিক হয়েছে। বাংলাদেশেও দুই মেয়াদে নির্বাচন করতে নির্দেশনা বহাল আছে। পাকিস্তানে সুপ্রিম কোর্টকে মানা হয়েছে, বাংলাদেশে হচ্ছে না।
২০১৩ সালে লতিফুর রহমান-মার্কা ১৮ সচিব বদলের ঘটনা ঘটলে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করেন। সেটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেনে নেয়। কিন্তু তাই বলে সেই যুক্তিতে তারা ব্যবস্থাটাই বাতিল করেনি। ইসির অনুমতি ছাড়া পাকিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো কর্মকর্তাও বদলি করতে পারে না। মেহবুবের সুপারিশ, বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো নির্বাচনকালীন সরকার নির্বাচিতরা মিলেই করুন। ভারতীয় ইসির কঠোর গাইডলাইন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও কানাডার কেয়ারটেকার
কনভেনশনের আদলে ইসিকে দিয়ে গাইডলাইন করানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ নেই।
কেয়ারটেকার বা দলীয়—যে সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক না কেন শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন ও সমঝোতার সংস্কৃতি ছাড়া গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচন এবং কার্যকর সংসদ ও সরকার কল্পনা করা কঠিন। মাহবুব তালুকদারের নোট অব ডিসেন্টকে স্বাগত জানাই। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অকিঞ্চিৎকর। মাহবুব তালুকদার সরকারি দলের কথায় আচরণবিধি সংশোধনে পরিহাস দেখেছেন। আর রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজসহ সবার সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘ সংলাপের পর সেসব সুপারিশ কিছু বেছে নিতে কমিশনের এ পর্যন্ত একটি বৈঠকেও না বসার বিষয়টিকে আমরা (সম্প্রতি ইসি এ বিষয়ে রঙিন প্রকাশনা বের করেছে) জাতির সঙ্গে ইসির পরিহাস হিসেবেই বিবেচনা করতে চাই।

মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]