মাশরাফি-সাকিবের নির্বাচন করা না-করা

মাশরাফি বিন মুর্তজা ও সাকিব আল হাসান নির্বাচন করতে পারেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল
মাশরাফি বিন মুর্তজা ও সাকিব আল হাসান নির্বাচন করতে পারেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল


হয়তো ব্যাপারটা এ রকম—যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়াপড়শির ঘুম নাই। আসন্ন টি-টোয়েন্টি সিরিজ নিয়ে অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ব্যস্ত। মোস্তাফিজ আহত, অধিনায়ককে ভাবতে হচ্ছে একাদশ নিয়ে। মাশরাফিও নিশ্চয়ই নিজের জগতে নিজের কাজ নিয়ে ব্যাপৃত। কিন্তু আমাদের চায়ের কাপে ঝড় উঠেছে। ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা ও সাকিব আল হাসান নির্বাচন করতে পারেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেছেন, তাঁরা যদি নির্বাচনে আসেন, তাহলে তাঁদের ভোট দেবেন।

গত মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে তিনি এ আহ্বান জানান। পরে বিকেলে তিনি বলেন, এটা তিনি দলের পক্ষ থেকে বলেননি, এমনকি সাকিব-মাশরাফি নিজেরা আদৌ নির্বাচন করবেন কি না, এটা নিয়ে কোনো কথা তাঁর সঙ্গে হয়নি।

৩০ মে সংবাদ সম্মেলনে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হয় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে। প্রথম আলো অনলাইনের খবর: প্রধানমন্ত্রীকে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, তারকারা রাজনীতিতে এলে তৃণমূলের রাজনীতিবিদদের নির্বাচনে আসাটা বাধাগ্রস্ত হবে কি না। প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকের সেই শঙ্কা উড়িয়েই দেন, ‘পৃথিবীর সব দেশেই তারকারা মনোনয়ন পেয়ে থাকেন। এটা নতুন কিছু নয়। এখন কারও যদি আকাঙ্ক্ষা থাকে নিশ্চয়ই...তাঁরা আমাদের দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছেন, খেলাটাকে ভালো অবস্থানে নিয়ে এসেছেন। পৃথিবীর সব দেশেই এটা দেখা যায়। তার মানে এই নয় যে তৃণমূলের নেতারা মনোনয়ন পান না। আমরা সবাই তৃণমূল থেকে এসেছি। স্কুলজীবন থেকে রাজনীতি করে উঠে এসেছি। আমরা সেলিব্রেটি হয়ে আসিনি। কাজেই আমরা তো আছিই।’

আমার ফেসবুকে আমি এই প্রশ্নটা করেছিলাম: সাকিব আর মাশরাফির নির্বাচন করার খবর হাওয়ায় ভাসছে। আপনার মত কী?

১২ ঘণ্টায় আমি মন্তব্য পেয়েছি ৭১০ জনের। কৌতূহলের বিষয়, মন্তব্যকারীরা একেকজন একেক রকম মত দিয়েছেন। কেউ বলেছেন, ভালো। দেশপ্রেমিক দুর্নীতিমুক্ত নেতা তো আমাদের দরকার। কেউ বলেছেন, তাঁরা রাজনীতি করতে পারেন, তবে এখন নয় আরও পাঁচ বা দশ বছর পরে। কেউ বলেছেন, খেলা থেকে অবসর নেওয়ার পর তাঁরা রাজনীতি করতেই পারেন। কেউ বলেছেন, এটা হবে তাঁদের জন্য সবচেয়ে বড় ভুল। অনেকেই বলছেন, না। না। না। আলোচনা জমে উঠেছে।

আমার মনে হয়, সাকিব আর মাশরাফির রাজনীতি বা নির্বাচন নিয়ে এখনই ভাবা উচিত কি না, এই প্রশ্নের জবাব সবচেয়ে ভালো দিয়েছেন মাশরাফি নিজেই। দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের বই মাশরাফিতে আমরা পড়েছি, মাশরাফি বলেন:

‘আমি বলি, এই যারা ক্রিকেটে দেশপ্রেম দেশপ্রেম বলে চিৎকার করে, এরা সবাই যদি এক দিন রাস্তায় কলার খোসা ফেলা বন্ধ করত, একটা দিন রাস্তায় থুতু না ফেলত বা একটা দিন ট্রাফিক আইন মানত, দেশ বদলে যেত। এই এনার্জি ক্রিকেটের পেছনে ব্যয় না করে নিজের কাজটা যদি সততার সঙ্গে একটা দিনও সবাই মানে, সেটাই হয় দেশপ্রেম দেখানো।’

এই কথাটা সক্রেটিসেরও কথা। প্লেটোর সঙ্গে সংলাপে অনেকটা এই রকমটাই বলেছেন সক্রেটিস: সর্বোচ্চ দেশপ্রেম হলো সবচেয়ে সুন্দরভাবে নিজের কাজটুকু করা।

এখন সাকিব আল হাসানের কিংবা মাশরাফি বিন মুর্তজার ক্রিকেট খেলার সময়। এখন তাঁদের দেশকে দিয়ে যেতে হবে, আর দেওয়াটা হবে ক্রিকেটের মধ্য দিয়েই। এ ক্ষেত্রে তাঁদের মনঃসংযোগে যেন সামান্য চিড়ও ধরতে না পারে। কোনো কাজ সবচেয়ে বেশি একাগ্রতা দিয়ে, সবচেয়ে বেশি সাধনা দিয়ে, সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা দিয়ে করার নামই আসলে প্রতিভা।

কোনো কবি যদি বুঝে ফেলেন যে তাঁর একটা ছন্দপতনে পৃথিবীর কারও কিছু যায়-আসে না, তিনি লিখতে পারবেন না। তাঁকে বিশ্বাস করতে হবে যে এই একটা লাইন নির্ভুল ছন্দে সর্বোৎকৃষ্টভাবে লেখার ওপরে নির্ভর করছে মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ, এর কাছে সব তুচ্ছ, অর্থবিত্ত, ক্ষমতা, জগৎ-সংসার। এই রকম মনঃসংযোগ ঘটাতে পারেন বলেই তিনি লিখতে পারেন।

যেকোনো বিষয়েই এটা সত্য। একজন ব্যাটসম্যান যখন ব্যাট হাতে দাঁড়ান, তাঁর সমস্ত চৈতন্য, সমস্ত অস্তিত্বজুড়ে থাকে শুধু বোলারের হাতের বলটা, একটুখানি মনোযোগের অভাব মানেই ব্যর্থতা।

মাশরাফি বিন মুর্তজার কাছে আমরা আরও কিছুদিন ক্রিকেটটাই চাই। সাকিব আল হাসানের কাছেও তাই চাই। এখন তাঁদের মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটুক, তা আমরা কিছুতেই চাইব না। তারপর যখন তাঁরা ক্রিকেট ছাড়বেন, তাঁরা রাজনীতি করতে চাইলে রাজনীতি করবেন। রাজনীতি মানে তো রাজার নীতি নয়, রাজনীতি মানে হলো নীতির রাজা। তাঁরা যদি নির্বাচন করতে চান, অবসর নেওয়ার পরে করবেন।

আমাদের সমাজে অনেকেই পেশাজীবীদের, শিল্পী-সাহিত্যিকদের সচ্ছলতাকে ভালো চোখে দেখতে চান না। যেন শিল্পী মানেই দুস্থ শিল্পী। ভ্যান গঘের মতো, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো না খেয়ে না থাকলে শিল্পী কিসের। কিন্তু কোনো একজন পেশাজীবী বা শিল্পী যদি নিজের কাজটার মাধ্যমেই স্বীকৃতি, সম্মান এবং সচ্ছলতা অর্জন করতে পারেন, তার চেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারে না।

তবে রাজনীতি মানে সব সময় দলীয় আনুগত্যকেই যেন না বুঝি। আমাদের রাজনীতিসচেতন হতে হবে। শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, খেলোয়াড়েরা দেশের ডাকে সাড়া দেবেন, আত্মোৎসর্গ করবেন, এটাও আমরা চাইব। আমাদের ক্রিকেটাররাও তা করেছেন। আমরা শহীদ ক্রিকেটার জুয়েলের কথা জানি, মুশতাকের কথা জানি। শহীদ ক্রিকেটার আবদুল হালিম চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন, বীর বিক্রম খেতাব পান। আমাদের শিল্পী-সাহিত্যকদের ভূমিকা এই দেশের জন্ম-ইতিহাসে গৌরবের সঙ্গে লেখা রয়েছে।

তবে আজকাল রাজনীতি সচেতনতার জায়গা করে নিচ্ছে দলীয় আনুগত্য, কখনো কখনো দলাদলি। পেশাজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিকেরা রাজনীতির ক্যাডারদের মতো আচরণ করেন—কখনো কখনো, কেউ কেউ। সেটা শোভন বলে মনে হয় না এবং এটা ক্ষতিকরও। নগদ প্রাপ্তির আশায় দলবাজির ইঁদুর দৌড়ে যদি একজন পেশাজীবী কিংবা বুদ্ধিজীবীকে শামিল হতে দেখি, তখন দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা জাগে।

বুদ্ধিজীবীর একটা প্রধান কাজ হলো স্বাধীন মত প্রকাশ করা এবং অনেক সময় সবাই যেটাকে ভালো বলছে, নিজের বিবেক যদি তা বেঠিক বলে মনে করে, সেই ভিন্নমতটা তুলে ধরা। গড্ডলপ্রবাহে ভেসে যাওয়া বুদ্ধিজীবীর কাজ নয়। জানি, বিদ্রোহ, কিংবা ভিন্নমত প্রকাশ করা বিপজ্জনক। কিন্তু তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া কি ইত্তেফাক-এ স্বাধীনভাবে লিখতে গিয়ে কারাগারে যাননি? গেছেন এবং তারপরেও মাথা নত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। সহস্রাধিক বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবী শহীদ হয়েছেন একাত্তর সালে।

মাশরাফি বিন মুর্তজা কিংবা সাকিব আল হাসান কিংবা অন্য কোনো খেলোয়াড় কিংবা অন্য অঙ্গনের সফল জনপ্রিয় তারকারা রাজনীতিতে এলে ভালোই হবে। কারণ, আমাদের নেতৃত্বে তারুণ্য দরকার।

কিন্তু তারও আগে যার যা কাজ, তাকে সেই কাজটা ঠিকমতো করতে হবে। শিক্ষক ক্লাস নেবেন, পরীক্ষা নেবেন, গবেষণা করবেন, ডাক্তার চিকিৎসা দেবেন, গবেষণা করবেন, মানবতার সেবা করবেন। সবাই যদি নিজের কাজ করেন, দেশ এগিয়ে যাবে। সবাই যদি নিজের কাজ ফেলে দেশোদ্ধার করতে যান, রাজার পুকুরে তখন দুধের বদলে শুধু পানিই থাকবে।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক