হিসাব করে জাকাত দিন

সাহাবায়ে কিরাম সাধারণত রমাদান মাসেই জাকাত প্রদান করতেন, তাই রমাদান মাসে জাকাত প্রদান করা উত্তম। রমাদানের যেকোনো একটি দিনকে সমাপনী দিন ধরে উপরিউক্ত জাকাতযোগ্য খাতসমূহের সব সম্পদের হিসাব করে জাকাত নির্ধারণ করতে হবে। জাকাত ফরজ হওয়ার জন্য অন্তত নিসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক চান্দ্রবছর (৩৫৪ দিন) থাকতে হবে। সম্পূর্ণ সম্পদের বছর অতিক্রান্ত হওয়া শর্ত নয়।

প্রতিবছর একই তারিখে ও একই সময় হিসাব করতে হবে। যেমন ১ রমজান সন্ধ্যা ছয়টা। এই সময়ের এক সেকেন্ড আগে যে সম্পদ আসবে, তা জাকাত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে। এই সময়ের এক সেকেন্ড পর যে সম্পদ আসবে, তা পরবর্তী বছরের হিসাবে যাবে।

সোনা সাড়ে সাত ভরি বা তদূর্ধ্ব, রুপা সাড়ে বায়ান্ন ভরি বা তদূর্ধ্ব অথবা এর সমমূল্যের নগদ টাকা, (বিনিময়যোগ্য বৈদেশিক মুদ্রা, ট্রাভেলার্স চেক, ব্যাংক চেক, ব্যাংক ড্রাফট, পে-অর্ডার, পোস্টাল অর্ডার, মানি অর্ডার, শেয়ার সার্টিফিকেট, কোম্পানি শেয়ার, ডিও লেটার, সঞ্চয়পত্র, সিকিউরিটি মানি, জামানত, প্রাইজ বন্ড, ট্রেজারি বন্ড ইত্যাদি। ব্যাংকে বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাখা আমানত; যেমন বিমা, কারেন্ট অ্যাকাউন্ট, সঞ্চয়ী অ্যাকাউন্ট, মেয়াদি সঞ্চয়, কিস্তিতে জমা, এফডিআর, পোস্টাল সেভিংস, বিশেষ সঞ্চয়, পেনশন স্কিম ও অফিশিয়াল প্রভিডেন্ট ফান্ড, স্বেচ্ছা প্রভিডেন্ট ফান্ড, ডিভিডেন্ট। এসব এই তারিখে নগদায়ন করলে যা পাওয়া যাবে। ফেরত পাওয়ার যোগ্য প্রদত্ত ঋণ, ব্যবসাপণ্য ও মূল্যবান শোপিস বা মূলবান পাথর (হীরা-জহরত, মণিমাণিক্য মুক্তা ইত্যাদি। এসবের বর্তমান বাজারমূল্য, অর্থাৎ বর্তমানে নতুন কিনতে যে মূল্য। শেয়ার সার্টিফিকেটের নামিক মূল্য ও বাজারদর—এর মধ্যে যেটি বেশি, সেটি হিসাব করতে হবে। ব্যবসায়িক নার্সারি, হর্টিকালচার, বীজ উৎপাদন খামার, কৃষিখামার, বনজ বৃক্ষখামার, ফলজ বৃক্ষখামার, ঔষধি গাছের খামার, চা-বাগান, রাবারবাগান, তুলাবাগান, রেশমবাগান, আগরগাছের বাগান, অর্কিড নার্সারি ও ফুলবাগান, মুরগির খামার, মাছের খামার ইত্যাদি এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত সামগ্রী। এসবের বর্তমান বাজারমূল্য, অর্থাৎ বর্তমানে বিক্রয়মূল্য ধরতে হবে।

জাকাত বর্ষপূর্তি বা জাকাত হিসাব সমাপনী দিনে উক্ত তিন খাতে যত সম্পদ থাকবে, পুরোটারই জাকাত দিতে হবে। বছরের মধ্যে যেকোনো সময় অর্থাগম ঘটলে, বছর শেষে জাকাত প্রদান করতে হবে। যেদিন অর্থসম্পদ নিসাব পর্যায়ে পৌঁছাবে, সেদিন থেকেই জাকাত বর্ষ গণনা শুরু হবে।

জাকাতযোগ্য সম্পদের আড়াই শতাংশ প্রদান করতে হয়। জাকাত চান্দ্রবর্ষের হিসাব অনুযায়ী আদায় করতে হয়। চান্দ্রবর্ষ ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনে হয়, যেহেতু সৌরবর্ষ ৩৬৫ দিনে বা ৩৬৬ দিনে হয়, তাই সৌরবর্ষ অপেক্ষা চান্দ্রবর্ষ ১১ বা ১২ দিন কম। সৌরবর্ষ হিসেবে জাকাত আদায় করতে চাইলে ২.৫ শতাংশের পরিবর্তে ২.৫৭৮ শতাংশ বা ২.৫৮ শতাংশ দিতে হবে। অথবা মূল জাকাতের সঙ্গে অতিরিক্ত ১১ দিনের হিসাব যোগ করতে হবে।

বাড়ি-গাড়ি, জায়গাজমি ও স্থাবর সম্পদ, যা বিক্রয়ের জন্য রাখা হয়নি, তা জাকাত হিসাবের অন্তর্ভুক্ত হবে না। গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমি—যেগুলো বিক্রয়ের জন্য রাখা হয়েছে, সেগুলোর বর্তমান বিক্রয়মূল্য (বাজারদর) জাকাতের হিসাবে আসবে।

যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জাকাত প্রদানের নিয়ম হলো: কোম্পানি বা মালিকগণের সম্পদ আলাদা হিসাব করে দেওয়া হবে এবং এ সম্পদে যদি মালিক নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হন বা তাঁর অন্য সম্পদসহ যদি নিসাব পরিমাণ হয়, তবে জাকাত দিতে হবে;
অন্যথায় নয়। যৌথ মালিকানার ক্ষেত্রে কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান সম্মিলিত সম্পদ থেকে জাকাত প্রদান করলে সে সম্পদের জাকাত পুনরায় দিতে হবে না। কোম্পানির এমন কোনো অংশীদার থাকতে পারেন, যাঁর সম্পদ নিসাব পরিমাণ নয় অথবা তাঁর এ সম্পদ ও অন্যান্য সম্পদ মিলেও নিসাব পরিমাণ
হবে না, তাহলে তাঁকে জাকাত প্রদানে বাধ্য করা সঠিক হবে না। তদুপরি মালিকে নিসাব হলেও সকল অংশীদারের জাকাত বর্ষের শুরু ও শেষ এক না-ও হতে পারে।

অনেক ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা রয়েছেন, যাঁরা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করে থাকেন। কখনো দেখা যায় তাঁদের সম্পদ অপেক্ষা ঋণের পরিমাণ বেশি। এমতাবস্থায়ও তাঁদের ওই তিন খাতের সমুদয় সম্পদেরই জাকাত প্রদান করতে হবে।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক

smusmangonee@gmail,com