চীন-আমেরিকা সম্পর্কের চিড় কতটা গভীর

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সি চিন পিং
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সি চিন পিং

যে পর্যবেক্ষকেরা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধের গতিপ্রকৃতির দিকে খেয়াল রাখছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জেনে গেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সংরক্ষণবাদী ভাবাদর্শের সমতালে চীনও নিয়মবহির্ভূত বাণিজ্য চালানো শুরু করেছে। এটিই এই দুই দেশের বাণিজ্যযুদ্ধকে উসকে দিচ্ছে।
কিন্তু শুধু এদিক থেকে দেখলে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ পড়ে যাবে। সেটি হলো, এই বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে কয়েক দশক ধরে চলা যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক রক্ষার নীতি ধীরে ধীরে শেষ হয়ে হচ্ছে।
বাণিজ্য-সংক্রান্ত ঝগড়াঝাঁটি নতুন কিছু নয়। হঠাৎ যদি দেখা যায়, বন্ধুপ্রতিম কোনো দুটি দেশ আশির দশকের যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের বিবাদের মতো কোনো বিবাদে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে আন্দাজ করা যাবে বিবাদের আসল কারণ হলো অর্থনীতি। কিন্তু চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এখন যেটা চলছে, সে রকম জটিলতা কোনো মিত্রদেশের মধ্যে থাকলে বুঝতে হবে, শুধু অর্থকড়িই শেষ নয়। তাদের মন–কষাকষির জন্য অর্থের বাইরে অন্য বিষয় দায়ী।
গত পাঁচ বছরে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক মূলগতভাবেই বদলে গেছে। চীন উত্তরোত্তর যে কতটা কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে, তা গত মার্চে প্রেসিডেন্ট পদের নির্ধারিত মেয়াদ উঠিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে বোঝা গেছে। এই কর্তৃত্ববাদী চীন একটি রাষ্ট্রীয় শিল্পনীতি গ্রহণ করেছে, যার আওতায় দেশটি ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’ শীর্ষক একটি পরিকল্পনার পথ ধরে এগোচ্ছে।
এর বাইরে অঞ্চলভিত্তিক ভূরাজনৈতিক প্রভাব নিজের মুঠোর মধ্যে রাখতে চীন দক্ষিণ চীন সাগরে কৃত্রিম দ্বীপ বানানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্প এগিয়ে চলেছে, যা আমেরিকার বৈশ্বিক শ্রেষ্ঠত্বকে ক্রমে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। এসব কিছু যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে তার চীনবিষয়ক নীতি একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিষয়ে নতুন একটি নীতি দাঁড়
করানোর চেষ্টা করছে। যদিও সেই নীতি এখনো সে দাঁড় করিয়ে উঠতে পারেনি, তবে চীন ইস্যুতে তার মনোভাব খুবই স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল গত ডিসেম্বরে এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা কৌশল গত জানুয়ারিতে প্রকাশ করা হয়েছে।
এই দুটি কৌশলপত্রে চীনকে যুক্তরাষ্ট্র ‘সংশোধনবাদী শক্তি’ মনে করছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে এবং
কৌশলপত্র দুটিতে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে
যুক্তরাষ্ট্রকে হটানোর’ চীনা প্রচেষ্টা মোকাবিলা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে।
এই লক্ষ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এগোচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের যে বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য উদ্বৃত্ত হয়, দুই বছরের
মধ্যে সেখান থেকে ২০ হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য
উদ্বৃত্ত চীনকে কমিয়ে ফেলতে বলেছেন ট্রাম্প।
মার্কিন কংগ্রেস শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রে চীনের বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করে একটি বিল পাস করতে যাচ্ছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে অধ্যয়নরত চীনের শিক্ষার্থীদের ভিসার সুযোগ সংকীর্ণ করে আনার কথাও ভাবা হচ্ছে।
আসলে বিদ্যমান এই বাণিজ্য–সংকট শুধু অর্থকড়িকে ঘিরেই ঘুরপাক খাচ্ছে তা নয়, অর্থের বাইরেও এমন কিছু বিষয় এর সঙ্গে জড়িত হয়ে আছে যে এই সংকট সামাল দেওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।
চীন হয়তো কিছুটা ছাড় দিয়ে স্বল্প মেয়াদে একটি বিধ্বংসী বাণিজ্যযুদ্ধ এড়াতে পারবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের গতিপথ কল্পনা করলে দেখা যাবে, এই দুই দেশের মধ্যে ক্রমান্বয়ে কৌশলগত সংঘাত বাড়বে এবং একপর্যায়ে সেটি সর্বাত্মক শীতল যুদ্ধে রূপ নেবে।
এমন প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান
বিষয় হয়ে উঠবে চীন। উভয় দেশই পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে ঝামেলা মনে করবে এবং সে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করবে।
নিজের বাজারে চীনকে ব্যবসা করতে দেওয়াকে যুক্তরাষ্ট্র আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড বলে মনে করবে এবং এটিকে তারা অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক পরাজয় বলে মনে করবে। চীনের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা হবে। তারাও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রযুক্তিগত নির্ভরশীলতাকে তাদের ব্যর্থতা হিসেবে দেখবে।
দুই দেশের মধ্যে এখনো পরমাণু অস্ত্রের কোনো প্রতিযোগিতা শুরু হয়নি, সেটা ঠিক। কিন্তু সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন দুই দেশের মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। তবে আশার বিষয় এই যে উভয় দেশই এখন পর্যন্ত শীতল যুদ্ধের মতো কিছুতে জড়াতে চাচ্ছে না। কোনো প্রক্সি যুদ্ধেও জড়াচ্ছে না। আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কাজ করতে তালেবানকে চীন মদদ দিচ্ছে না কিংবা চীনে উইঘুর বিদ্রোহীদের আমেরিকা সহায়তা করছে না।
সে রকম কিছু শুরু হলে পরিস্থিতি আসলেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। দুই দেশে যতক্ষণ পর্যন্ত সুশৃঙ্খল সরকার ক্ষমতায় থাকবে, ততক্ষণ তেমনটি ঘটার আশঙ্কা নেই। কিন্তু সেই আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলছেন ট্রাম্প। সাবেক প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের মতোই তিনি ক্রমাগত অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন। চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটিই এখন ভয়ের বিষয়।
যা–ই হোক, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যে বাণিজ্যযুদ্ধ চলছে, সেটি দীর্ঘ মেয়াদে চলতে থাকবে এবং এই বৈরিতা বাড়তেই থাকবে। এই দ্বন্দ্বের মধ্য থেকে ফলাফল যা–ই আসুক না কেন, তার জন্য এই দুই দেশের, এশিয়ার,
এমনকি গোটা বিশ্বের স্থিতিশীলতাকে নিশ্চিতভাবে চড়া মূল্য দিতে হবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

মিনজিন পেই চীনা অর্থনীতিবিদ ও লেখক