গণতন্ত্রের 'গণ' কোথায়?


লেখক-গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ ৬ জুন প্রথম আলোয় লিখেছেন, ‘বিএনপি এখন কী করবে?’ তাঁর নিবন্ধের মূল বিষয়, বিএনপি আওয়ামী লীগের শর্ত মেনে নিয়ে নির্বাচন করবে অথবা আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের পতন ঘটাবে। তাদের কাছে তৃতীয় বিকল্প নেই। তবে এখানে যে প্রশ্নটি সামনে আসে, তা হলো কোনো দল তার করণীয় ঠিক করে পরিপার্শ্বিক কিছু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে।

বিএনপি কী করবে, সেই প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন আসে—আওয়ামী লীগ কী করবে? বিএনপি আবারও নির্বাচন বর্জন করবে কি না সেই প্রশ্ন যেমন জরুরি, তেমনি এটি কম জরুরি নয় যে আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের মতো আরেকটি নির্বাচন করবে কি না?

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ নির্বাচন। কিন্তু রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করে কোনো সরকারের পতন ঘটানো গণতন্ত্রের অংশ হতে পারে না। এ রকম আন্দোলন-সংগ্রাম করে তখনই সরকার উৎখাতের প্রশ্ন আসে, যখন দেশে কোনো সামরিক বা স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় থাকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা নামানোর একমাত্র উপায় নির্বাচন। এবং সেই নির্বাচনটি হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও ভয়মুক্ত।

একটি দেশে কখন বিরোধী দলকে হরতাল অবরোধের ডাক দিতে হয়? গণতন্ত্র নেই বলে চিৎকার করতে হয়? যখন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ ও প্রতিবাদের ভাষা রুদ্ধ হয়ে যায়; যখন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো অকেজো হয়ে পড়ে, তখনই মানুষ রাজপথে নেমে আসে। ভয়ভীতি দেখিয়ে বিরোধী দলকে খামোশ করা গেলেও গণমানুষকে খামোশ করানো যায় না। তরুণদের মিথ্যা ছলনায় ভোলানো যায় না। চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনই তার প্রমাণ। আন্দোলনের প্রায় দুই মাস অতিবাহিত হলেও সরকার তরুণদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। পরীক্ষার বিষয়ে ছাড় দিলেও তাঁরা ক্লাস বর্জন করছেন। এটিও একধরনের ‘হরতাল’।

বিএনপি আন্দোলন-সংগ্রাম করতে পারে না বলে আওয়ামী লীগের নেতারা যে উপহাস করেন, সেটি কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের ওপরই ফিরে আসে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বন্দুকের জোরে ক্ষমতায় আসেন ১৯৮২ সালে। কিন্তু আওয়ামী লীগ-বিএনপি মিলেও নব্বইয়ের আগে তাঁর পতন ঘটাতে পারেনি। এর অর্থ এই নয় যে এরশাদের শাসন বৈধ ছিল। এমনকি আওয়ামী লীগ ২০০৬ সালে সর্বাত্মক আন্দোলন করেও ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামাতে পারেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে চারজন উপদেষ্টা (আকবর আলি খান, সুলতানা কামাল, হাসান মশহুদ চৌধুরী ও শফি সামি) পদত্যাগ করার পরও ইয়াজউদ্দিন বহাল ছিলেন। পরে ওয়ান ইলেভেনে যেই কুশীলবেরা তাঁকে ক্ষমতা থেকে নামালেন, আওয়ামী লীগের নেতারা তো তাঁদের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবেই চিহ্নিত করেন। তাহলে তাঁরা নিজেদের আন্দোলনের চ্যাম্পিয়ন দাবি করেন কীভাবে? সেদিন সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ না করলে হয়তো বিএনপিও একটি একতরফা নির্বাচন করে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকত। কিন্তু তাতে বিএনপির গদি রক্ষা হলেও গণতন্ত্র রক্ষা হতো না। এখন একই প্রশ্ন যদি বিএনপি আওয়ামী লীগকে করে, তারা কী জবাব দেবে?

আওয়ামী লীগের নেতারা প্রায় প্রতিদিনই বিএনপির আমলের দুঃশাসন ও অপকর্মের কথা দেশবাসীকে শুনিয়ে থাকেন। তাঁদের এই বয়ান পুরোপুরি মিথ্যে নয়। যে সরকার ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার হোতাদের বাঁচাতে জজ মিয়া নাটক সাজায়, তাদের স্বৈরতান্ত্রিক চরিত্র উন্মোচনের জন্য দ্বিতীয় উদাহরণের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু মানুষ তো সামনে এগোয়, পেছনে যায় না। বিএনপি-জামায়াতের ‘অগণতান্ত্রিক’ শাসনামলে গণমাধ্যম যেটুকু স্বাধীনতা ভোগ করত, এখন আওয়ামী লীগের ‘গণতান্ত্রিক’ আমলে যদি সেটুকু করতে না পারে, তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে? আন্দোলন-সংগ্রামে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার চেয়ে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অনেক বেশি জরুরি। আবার সরকারের স্থায়িত্ব দিয়েও তার গণতান্ত্রিক চরিত্র নিরূপণ করা যায় না। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকারের স্থায়িত্ব ছিল তুলনামূলক কম (এই হিসাবে খন্দকার মোশতাকের ৮১ দিনের অবৈধ শাসনকে অন্তর্ভুক্ত করছি না)। অথচ একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনাসহ গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছিল স্বাধীনতা-পরবর্তী সাড়ে তিন বছর বয়সী সেই সরকারই।

নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রাত্যহিক মন্ত্র হলো বিএনপি-জামায়াত চক্রকে ক্ষমতায় আনা যাবে না। যেকোনো মূল্যে তাদের ক্ষমতায় আসার পথ বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় গণতন্ত্র থাকবে না। দেশের স্বাধীনতা নস্যাৎ হয়ে যাবে। আবার বিএনপির নেতাদের তপস্যা হলো, এই স্বৈরাচারী ও গণতন্ত্র ধ্বংসকারী সরকারকে হটাতে হবে। তাদের ক্ষমতা থেকে বিদায় করতে পারলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুসংহত হবে।

অর্থাৎ এক দল অপর দলের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র সংহত করার খোয়াব দেখছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারার সভাপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী একটি হক কথা বলেছেন (যদিও বিএনপির সঙ্গে যুক্ত থাকতে কথাটি তিনি বলেননি)। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি কেউ নিজেকে ক্ষমতার বাইরে ভাবতে পারে না। বিএনপির কর্মীরা ভাবে, ১০ বছর ধরে তাঁরা জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। ভবিষ্যতে ক্ষমতায় যেতে না পারলে তাঁদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। আর আওয়ামী লীগের কর্মীরা ভাবেন, ক্ষমতায় না থাকতে পারলে এখন বিএনপির কর্মীরা যে অত্যাচার–নির্যাতন সহ্য করছেন, তার চেয়েও বেশি তাঁদের ভোগ করতে হবে। কিন্তু এই পরিস্থিতি তো কোনো গণতান্ত্রিক দেশে হওয়ার কথা নয়।

দুই দলের মধ্যে যে নিরন্তর ‘নির্বাচনী যুদ্ধ’ চলছে, তাতে একে অপরকে দেখে নেওয়ার কিংবা দেখিয়ে দেওয়ার কথা আছে। কিন্তু যাঁদের জন্য এবং যাঁদের দ্বারা নির্বাচন, সেই জনগণের স্বার্থের কথা নেই। তরুণদের ভবিষ্যতের কথা নেই। কৃষকের সমস্যার কথা নেই। শ্রমিকের চাকরি সুরক্ষার কথা নেই। সড়কপথে যাত্রীদের বেঘোরে মারা যাওয়ার কথা নেই। নিরক্ষর মানুষকে সাক্ষর করার কথা নেই। বেকার যুবকদের কাজের কথা নেই। নারীর নিরাপত্তার কথা নেই। শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার কথাও নেই।

রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে ‘গণ’ থাকেন। নির্বাচন শেষ হলে ক্ষমতাসীনেরা সেই ইশতেহার এক পাশে ঠেলে রাখেন। তখন ‘গণ’ থাকে না, থাকে কেবল সমর্থকগোষ্ঠী, অনুগতজন। আর বিরোধী দল মনে করে, ক্ষমতায় একবার আসতে পারলে বর্তমানের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে। জনগণের ক্ষতি নিয়ে তাদেরও তেমন মাথাব্যথা নেই। এই গণেরা হলেন দলীয় বৃত্তের বাইরের মানুষ। অথচ আমাদের রাজনীতিকেরা দলের বাইরে কিছু ভাবতেই পারেন না।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আরেকটি শক্তিশালী পক্ষ থাকে—গণমাধ্যম। রাজনীতিকেরা বিরোধী দলে থাকলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য অতি উচ্চকণ্ঠ থাকেন। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে তাঁরাই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ান। তাঁরা বুঝতে অপারগ যে গণমাধ্যম যদি সত্য প্রকাশ করতে না পারে, তাতে শুধু গণমাধ্যম নয়, গণতন্ত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকার সত্য জানতে পারে না। আর সত্য থেকে দূরে থাকা সরকারের অবস্থা হয় অন্ধের হাতি দর্শনের মতো।

গণতন্ত্রে ‘গণের’ ভূমিকা কী, অতিসম্প্রতি ভারতের মানুষ দেখিয়ে দিয়েছে। কয়েকটি উপনির্বাচনে তারা ক্ষমতাসীন বিজেপিকে এমনভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে, যা প্রবল প্রভাবশালী নরেন্দ্র মোদিকেও ভাবিয়ে তুলেছে। যে বিরোধী দল এত দিন ছিল হীনবল ও বিচ্ছিন্ন, তারাই এখন হিন্দুত্ববাদ ও মোদিরাজের অবসান ঘটাতে এককাট্টা হয়েছে। গণতন্ত্রে অহংবোধ ও আস্ফালনের কোনো স্থান নেই। গণতন্ত্র দাবি করে সহিষ্ণুতা, সংবেদনশীলতা, সবাইকে নিয়ে চলা।

বর্তমান সরকারের বয়স প্রায় ১০ বছর হতে চলল। এই ১০ বছরে মানুষ স্বভাবতই চাওয়া-পাওয়ার একটি হিসাব নিতে চাইবে। তবে সেই হিসাবটি শুধু প্রবৃদ্ধির নয়। গড় আয় বা আয়ুরও নয়। সেই হিসাবটি হলো মানুষ হিসেবে মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারছে কি না? মানুষ সাহস করে সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলতে পারছে কি না।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি