আবার প্রকাশক হত্যা

আরও একজন পুস্তক প্রকাশককে হত্যা করা হলো। এবার চাপাতি কিংবা ধারালো কোনো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে নয়, বোমা ফাটিয়ে, গুলি চালিয়ে। সোমবার সন্ধ্যায় মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখানের কাকালদি গ্রামের একটি ওষুধের দোকানে প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চুকে হত্যা করার যে বিবরণ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা নাগরিকদের স্বাভাবিক নিরাপত্তার বোধ ভেঙে দিতে পারে। আততায়ীর সতর্ক আক্রমণ নয়, ওটা ছিল এক সংগঠিত প্রকাশ্য হত্যা অভিযান, যা সম্পন্ন করার পর হত্যাকারীরা নির্বিঘ্নে চলে গেছে।

শাহজাহান বাচ্চু বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) মুন্সিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মুক্তচিন্তার লেখক হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখি করতেন। তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমে লেখা হয়েছে, ২০১৫ সালে লেখক, প্রকাশক, ব্লগারদের নিহত হওয়ার ঘটনা বেড়ে গেলে তাঁর জীবনেও ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের তরফ থেকে হুমকি সৃষ্টি হয় এবং সে কারণে তাঁকে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হয়।

এসব প্রেক্ষাপটে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট এমন ধারণা প্রকাশ করেছে যে শাহজাহান বাচ্চু তাঁর মতাদর্শের কারণে হত্যার শিকার হয়ে থাকতে পারেন। এই ধারণা থেকেই তারা হত্যাকাণ্ডটি খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। আমরা মনে করি, বিশদ ও গভীর তদন্তের মাধ্যমে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার আগে কোনো পূর্বধারণার ওপর অতিরিক্ত জোরারোপ করা ঠিক হবে না। জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখেও হত্যাকাণ্ডের সম্ভাব্য অন্য সব দিক গভীরভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

এখানে লক্ষ করা যেতে পারে, এ দেশে এর আগে কথিত জঙ্গিদের দ্বারা যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সেগুলোর কোনোটাই এ রকম দুঃসাহসী ছিল না। হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে প্রতীয়মান হয়, হত্যাকারীরা সুসংগঠিত ও সুনিশ্চিত ছিল যে, হত্যা সম্পন্ন করে তারা নির্বিঘ্নে সরে যেতে সক্ষম হবে। তারা শাহজাহান বাচ্চুকে ওষুধের দোকান থেকে টেনে বের করে এনে বুকে গুলি করে হত্যা করার পর অনায়াসে সরে পড়েছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে ইসলামি জঙ্গিদের হামলার পদ্ধতি বদলে গিয়ে এখন মূলত ‘একাকী নেকড়ে’ (লোন উলফ) পদ্ধতিতে উপনীত হয়েছে। হামলা চালাচ্ছে একজন, বোমা-গুলি ব্যবহারের পরিবর্তে পথচারীদের ওপর ভারী যানবাহন তুলে দিয়ে কিংবা ছুরি মেরে লোকজনকে হত্যা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো বলে আসছে যে জঙ্গিদের কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে; বাস্তবেও জঙ্গি তৎপরতা আগের মতো দৃশ্যমান নেই। এই প্রেক্ষাপটে শাহজাহান বাচ্চুর হত্যাকাণ্ডের তদন্তে যদি এমন তথ্যপ্রমাণ বেরিয়ে আসে যে এটিও জঙ্গি তৎপরতারই অংশ, তাহলে নতুন করে উদ্বেগ জাগবে: তবে কি জঙ্গি তৎপরতা নতুন উদ্যমে আবার শুরু হলো? বিশেষ দুর্ভাবনার কারণ হবে এই যে আগামী ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা; নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশের জন্য শান্তিশৃঙ্খলা অপরিহার্য। জঙ্গি তৎপরতা নতুন করে শুরু হলে দেশজুড়ে যে নিরাপত্তাহীনতা ও ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হবে, তা কোনোভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের অনুকূল হবে না।

জঙ্গি তৎপরতা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর কিছু সাফল্য লক্ষ করা গেছে, কিন্তু এ বিষয়ে সমাজে চাপা উদ্বেগের নিরসন ঘটেনি। কারণ অনেকের ধারণা, জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো কম মাত্রায় হলেও গোপনে তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো বেশি গুরুত্ব দিয়ে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনার ওপর, গ্রেপ্তার জঙ্গিদের বিচার করে শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীর। এর আগের লেখক, ব্লগার, প্রকাশকদের হত্যার মামলাগুলোর অধিকাংশেরই বিচার–প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। তা ছাড়া, মতাদর্শ হিসেবে উগ্রপন্থা প্রসারের বিরুদ্ধে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। এসব দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
এই মুহূর্তের কাজ শাহজাহান বাচ্চুর হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করা এবং এই হত্যাকাণ্ডের পেছনের শক্তিকে চিহ্নিত করে বিচারের উদ্যোগ নেওয়া।