ঈদের বানানো গল্প

আম্মা ইদানীং চোখে কম দেখছেন। আশির ওপরে বয়স হয়েছে। আম্মা গ্রামে থাকেন। আমরা চার ভাই, দুই বোন। আমরা পাঁচ ভাইবোন দেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকি। আমার নাম ডাবলু। আমি থাকি ঢাকায়। আমার আরও এক ভাই আর এক বোন ঢাকায় থাকে। আমার এক ভাই থাকে চট্টগ্রাম, এক ভাই খুলনা। আমাদের ছোট বোন থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। আম্মা একা একা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। গ্রামের বাড়িতে বিদ্যুৎ আছে। পানির পাম্প আছে, অ্যাটাচড বাথ। কমোড করে দেওয়া হয়েছে। আম্মা গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে থাকতে চান না। শহরে তাঁর দমবন্ধ লাগে। ছোট ছোট ফ্ল্যাট বাড়ি। আম্মার গ্রামই ভালো। জমিজমা দেখেন। উঠানে হাঁটেন। আম-জাম নানা ফলের গাছ আছে।

শুধু একটাই নিয়ম আছে আমাদের। ঈদে বাড়ি যেতেই হবে। আম্মার বয়স বাড়ছে, দৃষ্টিশক্তি কমে আসছে। ফোন করলে বলেন, ‘কে, বাবলু?’ 

‘আম্মা, আমি ডাবলু।’
‘ও। তোদের সব ভাইয়ের গলা একই রকম।’
আম্মার মোবাইল ফোনে আমাদের নাম তোলা আছে। কিন্তু আম্মা নাম পড়ে উঠতে পারেন না। বাবলু ডাবলু মাবলু পাবলু সব একাকার করে ফেলেন। আর সত্যিই আমাদের ভাইদের গলা নাকি একই রকম; বিশেষ করে ফোনে নাকি সবার গলা একই শোনায়।
আমি এবার দেশের বাড়ি যেতে পারব না। কিন্তু আম্মা ভীষণ দুঃখ পাবেন। আম্মা আর কিছুই দেখতে পান না, তবু গ্রামের বাড়ি ছেড়ে ছেলেমেয়েদের বাসায় এসে থাকবেন না। বাঁশঝাড়ের নিচে আব্বার কবর আছে। সেখানেই থাকবেন আম্মা। আমরা সব ভাইবোন মিলে চাঁদা তুলে একটা মসজিদ বানিয়ে দিয়েছি দাদার ভিটায়। সেখানে পাঁচ ওয়াক্ত আজান হয়। আম্মার সেসব তদারকি করতেই ভালো লাগে।
এবার আমার একটা ঝামেলা হয়েছে। আমি ঈদে বাড়ি যেতে পারব না। জার্মানি থেকে আমাদের কোম্পানির বড় সাহেবরা আসবেন। আমাকে ঢাকায় থাকতেই হবে। আমি ঠিক করলাম, আমি যাব না। বাবলু আর মাবলু যাবে। আর যাবে লাভলি। বাবলি বিদেশে থাকে, তার পক্ষেও আসা সম্ভব হবে না।
আমি বললাম, ‘বাবলু, তুই এক কাজ কর। আম্মা তো আর চোখে দেখে না। এবার বাড়ি গিয়ে তুই আম্মাকে দুইবার সালাম করবি। একবার বলবি, আমি বাবলু। আরেকবার বলবি, আমি ডাবলু। আম্মা চোখে ঠিকভাবে দেখেন না, আর আমাদের গলার স্বরও আলাদা করতে পারেন না। ঠিকই আম্মাকে বুঝ দেওয়া যাবে।’
ঈদের দিন বাবলু ফোন করল: ‘ভাইয়া, নাও আম্মার সঙ্গে কথা বলো।’
আমি বলি, ‘এই বাবলু, তোকে না বলেছিলাম প্রক্সি দিতে?’
বাবলু বলল, ‘দিয়েছিলাম। দুইবার সালাম করলাম। আম্মা একবারে ধরে ফেলল। বলল, ডাবলু কই? বাবলু, তুই আমাকে দুইবার সালাম করলি ক্যান?’
আমি ফোন ধরলাম, ‘আম্মা।’
আম্মা বললেন, ‘বাবা ডাবলু। শোন, আমি তোদের গলার স্বর আলাদা করতে পারি না। সেইটা সত্য। কিন্তু গায়ের গন্ধ আলাদা করতে পারি। বাবলু দুইবার সালাম করতে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলেছি। এবার ঈদে আসতে পারবি না?’
আমি বললাম, ‘মা, জার্মানি থেকে আমাদের অফিসের বস এসেছে। আচ্ছা, তা-ও দেখি কী করা যায়।’
ঈদের নামাজ পড়ে সকাল দশটায় গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম। দুইটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছানো গেল। ঈদের আগে হলে কমপক্ষে ১৮ ঘণ্টা লাগত। সেই পরিচিত রাস্তা, বাজে পোড়া অশ্বত্থগাছ, জোড়াপুকুর পেরিয়ে আমাদের উঠান। গাড়ি গিয়ে বাইরের খুলিতে থামল। আম্মা দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন, ‘ডাবলু, এসেছিস! আয়, শুকিয়ে গেছিস কেন, বাবা?’ আম্মা ব্রেইল পদ্ধতিতে আমার মুখমণ্ডল পড়তে লাগলেন। আমার যে ওজন কমে গেছে, তা-ও ঠিক ধরে ফেললেন। আমি কাঁদতে লাগলাম। আম্মা বললেন, ‘কাঁদছিস কেন পাগল। তিনি আঁচল দিয়ে আমার চোখের পানি মুছে দিতে লাগলেন।
আমরা আবার সবাই একখানে হয়েছি। পাঁচ ভাইবোন। তাদের ছেলেমেয়ে মিলে ২৪ জন। শুধু বাবলি অস্ট্রেলিয়ায়। আম্মার সঙ্গে স্কাইপে কথা বলিয়ে দেওয়া হলো তার।
আম্মা বললেন, ‘শোনো, সামনের ঈদে তোমাদের কারও আসার দরকার নেই। তোমরা সবাই ঈদুল আজহাটা করবে যার যার শ্বশুরবাড়িতে।’
‘কেন আম্মা?’
‘কারণ আমি মা। আমার ছয় ছেলেমেয়ে। প্রত্যেক ঈদে তোমরা আমার কাছে আসো। কিন্তু আমার বউমারাও তো কারও না কারও মেয়ে। বউমাদেরও তো ইচ্ছা হয় তাদের বাবা-মা-ভাইবোনের সঙ্গে ঈদ করার। আমার বেয়াই-বেয়াইনেরও তো ইচ্ছা হয়, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ঈদ করার। আমার জামাইরাও তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে ঈদ করতে পারে।’
আমি বললাম, ‘আম্মা, আপনি কি ঈদের দিন একা একা এই বাড়িতে থাকতে পারবেন? আপনি আমার সঙ্গে ঢাকা চলেন।’
আম্মা বললেন, ‘তোর আব্বার কবরটা যে আছে, বাবা।’
আমি বললাম, ‘ঈদের পরপরই চলে আসবেন। কোনো অসুবিধা হবে না।’
আম্মা বললেন, ‘আচ্ছা আমি যাব। কোরবানির ঈদটা ঢাকায় করব। আর তোদের আব্বার কবরটা আমি ঢাকা থেকেই জিয়ারত করতে পারব।
দুই চোখে তো আর কিছু দেখি না। মনের চোখ খুলে গেছে। দূর থেকেই দেখতে পাব।’
আমরা কোরবানির ঈদ ঢাকায় করছি। বনানীতে সাবরিনাদের বাড়িতেই করছি। মানে আমার শ্বশুরবাড়িতে। এটাই আম্মার নির্দেশ। আম্মাও তাঁর বেয়াইন বাড়িতেই উঠলেন। সাবরিনা হাসতে হাসতে বলল, ‘আম্মা এটা কেন করেছে জানো?’
‘কেন?’
‘আমি আম্মাকে বললাম, আম্মা দেখেছেন, আমাদের ছেলেদের ক্রিকেট টিম হেরে গেছে, আর মেয়েদের ক্রিকেট টিম কিন্তু ঠিকই এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এবারের ঈদটা কিন্তু সবার উচিত মেয়েদের বাপের বাড়িতে করা।’
আম্মার সেটা মনে ধরেছে। ওই ঈদে রাজি হননি, পরের ঈদটাতে ঠিকই রাজি হয়েছেন।
প্রিয় পাঠক, ধরতেই পারছেন, গল্পটা বানিয়ে লিখেছি। লেখকেরা যেকোনো কিছু বানিয়ে লিখতে পারে।
আমাদের সবার ঈদ শুভ হোক। সবার মনের মধ্যে শুভবাদ কায়েম থাকুক। জারি থাকুক। ঈদ মোবারক।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক