বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দিল্লিতে দৌড়ঝাঁপ

ওবায়দুল কাদের ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী
ওবায়দুল কাদের ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী

আমরা কি এ রকম একটি দৃশ্যের কথা কল্পনা করতে পারি: ভারতের নির্বাচনকে সামনে রেখে সে দেশের ক্ষমতাসীন বিজেপি ও বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতারা একের পর এক বাংলাদেশ সফরে আসছেন, রাজনৈতিক নেতা ও থিংক ট্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করছেন। আলোচনার পর কেউ অতীতের ভুল স্বীকার করে ভবিষ্যতে সম্পর্কোন্নয়নের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, কেউ সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নেওয়ার কথা বলছেন। 
না, আমরা এ রকম কোনো দৃশ্যের কথা ভাবতে পারি না। ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের যত দুর্বলতা-বিচ্যুতি থাকুক না কেন এ রকম দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করবেন কিংবা ক্ষুদ্র স্বার্থে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দেবেন বলে মনে হয় না। নিজেদের মধ্যকার ঝগড়া–বিবাদ নিজেরাই সমাধান করবেন। 
দুর্ভাগ্যজনক হলো, বাংলাদেশের রাজনীতিকেরা নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে পারি না বলে বারবার তাঁরা বিদেশে ধরনা দেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বিএনপি নেতারা বিদেশে গিয়ে কিংবা রাষ্ট্রদূতদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে নালিশ করেন। বিএনপি ক্ষমতায় থাকতেও আওয়ামী লীগ নেতারা একই কাজ করছেন। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট ও ইউরোপীয় কমিশনেও বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা গিয়ে নিজের যুক্তি তুলে ধরেন প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করেন। কিন্তু দেশের ভেতরে তাঁরা একসঙ্গে বসেন না। 
এই অবিমৃশ্যকারিতার পেছনে যা আছে, তা হলো জেদ ও একগুঁয়েমি। আওয়ামী লীগের অভিযোগ, বিএনপি নেতারা এখন দেশে–বিদেশে নালিশ করে বেড়াচ্ছেন। অর্থাৎ তাঁরা নালিশি গণতন্ত্রের চর্চা করছেন। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগ কি একইভাবে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে নালিশ করেনি? করেছে। তাহলে এখন বিএনপির নালিশকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ আছে কি? বিরোধী দলকে বিদেশে গিয়ে কখন নালিশ করতে হয়? যখন দেশে নালিশের সুযোগটি বন্ধ হয়ে যায়। 
সম্প্রতি বিএনপির তিন নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু ও হুমায়ুন কবিরের ভারত সফর নিয়ে দিল্লিতে তেমন প্রতিক্রিয়া না থাকলেও ঢাকার রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় চলছে। দিল্লিতে বিএনপির নেতারা কী কড়ার করে এসেছেন, অতীতের কোন ভুলের জন্য অনুশোচনা করেছেন, সেসব বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের প্রশ্ন, দেশের নির্বাচন নিয়ে বিদেশের মাটিতে এই দৌঁড়ঝাপ কতটা যুক্তিসংগত। আর দিল্লিতে তো শুধু বিএনপি নেতারা যাননি; সেখানকার থিংক ট্যাংক ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেননি। এর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দলের একটি বড়সড় প্রতিনিধিদল দিল্লি গিয়েছিণ বিজেপির আমন্ত্রণে। তারও আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা কংগ্রেসের আমন্ত্রণেও দিল্লি সফর করেছেন। একসময় সেক্যুলার কংগ্রেসকে আওয়ামী লীগের প্রকৃতিগত মিত্র ভাবা হতো। এখান দেখা যাচ্ছে, হিন্দুত্ববাদী বিজেপিও সেক্যুলার আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে অবাক হব না যদি দেখা যায়, ভারতবিরোধী বলে পরিচিত বিএনপি দিল্লির ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হয়েছে, ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ভারতে গ্যাস রপ্তানি করতে রাজি না হওয়ায় তারা ক্ষমতায় আসতে পারেনি। ভারতের ‘র’ বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। আবার বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, দেশি-বিদেশি শক্তি ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছে। এসব বক্তব্যে জনগণের রায়ের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ পায়। আমাদের নেতারা নির্বাচনে জিতলে বলেন, সব ঠিক আছে। আর হারলে নানা ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত খুঁজতে থাকেন। রাজনীতির বিরোধাভাস থেকে আমরা কবে বেরিয়ে আসতে পারব? 
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, বিএনপি নেতারা ভারতে গিয়েছিলেন নালিশ করতে। তাঁরা দেশের স্বার্থে কোনো কথা বলেননি। কী নিয়ে নালিশ করেছেন. সেটি তিনি খোলসা করে না বললেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি, বাংলাদেশে যাতে আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠ হয়, সে বিষয়ে বিএনপি নেতারা ভারতের সহযোগিতা চেয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, দিল্লিতে তাঁদের আলোচনা খুব ফলপ্রসূ হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়নি। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো লিখেছে, নির্বাচন নিয়ে কথা হয়েছে।
নির্বাচন করবে বাংলাদেশের মানুষ। জয়ী হতে চাইবে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা। এখানে বাইরের কারও হস্তক্ষেপ করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। তারপরও আমাদের রাজনীতিকেরা নির্বাচন এলে বিভিন্ন দূতাবাসে ধরনা দেন। আন্তর্জাতিক সংস্থায় ধরনা দেন। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশের জন্য এই ধরনা ও নালিশ যতটা লজ্জার, তার চেয়েও বেশি লজ্জার হলো সেই ধরনা ও নালিশের কারণটি দূর না করা। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও আমরা নির্বাচনের বিষয়ে রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারলাম না। এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কী হতে পারে? 
আওয়ামী লীগের নেতাদের হাবভাব ও কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, বিএনপি নেতাদের ভারত সফর তাঁরা ভালোভাবে নিতে পারেননি। তাঁরা হয়তো মনে করছেন, দিল্লিতে যাওয়ার ‘অধিকার’ একমাত্র আওয়ামী লীগের আছে। বড়জোর আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী হোসাইন মুহম্মদ এরশাদ যাবেন। কিন্তু বিএনপি কেন? প্রথম আলোর দিল্লি প্রতিনিধি সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘বিএনপির নীতি বদলের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পায়নি ভারত।’ সহকর্মী পার্থ শঙ্কর সাহার লেখার শিরোনাম ছিল ‘ভারতবিরোধী অবস্থান বদলাচ্ছে বিএনপি?’। বিএনপি নেতারা যদি ভারতবিরোধী অবস্থান বদল করে থাকেন, তাতে বিএনপির কতটুকু লাভ হবে জানি না, ভারতে বিজেপি সরকার নিঃসন্দেহ লাভবান হবে। বাংলাদেশের দর–কষাকষির জায়গা আরও সংকোচিত করে হবে। বিএনপির অবস্থান না বদলালে আওয়ামী লীগ দিল্লিকে এ কথা বলতে পারত যে তিস্তার বিষয়ে একটা কিছু করতেই হবে। দেশের ভেতরে তাদের রাজনৈতিক চাপ আছে।
কিন্তু দুই পক্ষের ধরনার পর ভারত মনে করবে, আওয়ামী লীগের কথা আমলে না নিলেও তাদের অসুবিধা নেই। আর বিএনপি নেতারা হয়তো এই ইঙ্গিতই দিয়ে এসেছেন, ‘আওয়ামী লীগ যেসব সুবিধা দিয়েছে, আমরা এর চেয়ে বেশি কিছু দেব।’ এই ধারণার পেছনে কারণ হলো, বিএনপি নেতারা তিস্তা-ট্রানজিট বিষয় পুরোপুরি নীরব। আশা করি, জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টির নেতারাও আওয়ামী লীগের কাছে নিজেদেন গুরুত্ব বাড়াতে শিগগিরই দিল্লি যাবেন এবং ভারত ‘সব ডিম এক ঝুড়িতে’ না রাখার কৌশলটি পুরোপুরি কাজে লাগাবেন। 
নিজের স্বার্থ পাগলেও বোঝে, কিন্তু আমাদের নেতারা বোঝেন না।