গুগল-পেন্টাগনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রকল্প নিয়ে নৈতিকতার প্রশ্ন উঠছে

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে তৈরি হচ্ছে সংশয়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে তৈরি হচ্ছে সংশয়।


যার ভেতর মানুষের তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বসানো হবে, তার নেওয়া সিদ্ধান্ত কতটুকু যৌক্তিক হবে বা তাকে কতটুকু ভরসা করা যাবে—নৈতিক এ প্রশ্ন এখন সামনে আসছে। পেন্টাগনের এক প্রকল্প ঘিরে তৈরি হয়েছে এ প্রশ্ন। কৃত্রিম বুদ্ধিমান প্রাণঘাতী ‘অস্ত্র’ তৈরিতে যুক্ত থাকবে না বলে পেন্টাগনের চুক্তি থেকে সরে এসেছে গুগল। যুক্তরাষ্ট্রের মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দপ্তর পেন্টাগন আর বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গুগল।

এখন যাকে নিরীহ বলে মনে হবে, মানুন আর না–ই মানুন, ভবিষ্যতে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে পাত্তা না দিয়ে পার পাবেন না। বিশেষ করে প্রযুক্তি আর সামরিক খাতে। কথাটি খুব ভালোভাবেই জানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন। তাই তো যুক্তরাষ্ট্রর প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেফ ম্যাটিস সুদূরপ্রসারী চিন্তা শুরু করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র পরিকল্পনার কেন্দ্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংযুক্ত করতে বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা ও সমর্থন চেয়েছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর জন্য কাজের প্রস্তাব পেলে কেউ কি বসে থাকবে? কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা বলে কথা।

একসময়ের ‘ডোন্ট বি এভিল’ নীতি মেনে চলা গুগল কর্তৃপক্ষও বসে থাকেনি। কাজ শুরু করেছিল পেন্টাগনের সঙ্গে। প্রকল্পের নাম ছিল ম্যাভেন। যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়নের মাধ্যমে ড্রোন বা চালকবিহীন যন্ত্র থেকে শুরু করে নানা যন্ত্রে ব্যবহার করা যাবে। তৈরি করা যাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমান সেনাবাহিনীও। কিন্তু গুগলের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষকেরাই পেন্টাগনের অভিসন্ধি বুঝতে পেরে সরে আসার ঘোষণা দিলেন। তারা গুগল থেকে পদত্যাগ করে জানিয়ে দিলেন আর যা–ই হোক ‘বিবেচনাহীন’ প্রোগ্রাম করা মানুষ মারার কল তৈরিতে কাজ তারা করবেন না। পেন্টাগন আর গুগল চুক্তি ভেস্তে গেল। কিন্তু তাতে আদৌ কি পেন্টাগনের কিছু আসে-যায়?

পেন্টাগনের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরির প্রকল্পে যুক্ত হওয়াটাই গুগলের নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। কেন গুগল এত বড় ঝুঁকি নিতে গেল? গুগল শুধু অর্থের জন্য পেন্টাগনের সঙ্গে কাজের চুক্তি করেনি, এটা পরিষ্কার। প্রযুক্তিবিষয়ক ওয়েবসাইট গিজমোডোর তথ্য অনুযায়ী, এ প্রকল্প থেকে গুগলের আয় হতো মাত্র ৯০ লাখ ডলার, যা গুগলের মতো ট্রিলিয়ন ডলারের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে যৎসামান্যই। প্রযুক্তি বিশ্বে নৈতিকতার দিক বিবেচনায় গুগল সহজেই এ অর্থ ছেড়ে দিতে পারত।

ম্যাভেন প্রকল্প নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই গুগল কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল। পেন্টাগনের এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য স্বনিয়ন্ত্রিত অস্ত্র তৈরি করা, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করে আঘাত হানতে সক্ষম। গুগলের সরবরাহ করা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সামরিক ড্রোনে সংযুক্ত করতে চাইছিল পেন্টাগন। গুগলের কর্মীরা অভিযোগ করছেন, পেন্টাগন শুধু ‘টেনসরফ্লো’ ব্যবহার করে সাধারণ এআই তৈরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ড্রোন থেকে ফুটেজ সংগ্রহের বাইরেও আরও যা কিছু চাইছিল, তা রীতিমতো বিভ্রান্তিকর। পেন্টাগনের পক্ষ থেকে একে ‘নিরীহ’ প্রকল্প বলা হয়েছিল।

গুগলের কর্মীদের অভিযোগ, পেন্টাগন যতই ভালো কথা বলুক, দুশ্চিন্তার কথাটি হচ্ছে, সামরিক বাহিনী এমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করতে চাইছে যাতে মানুষ খুন করতে কারও নির্দেশ লাগবে না। উদ্বেগের বিষয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতেই সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেওয়া হবে। সেটা বন্দুক, বোমা, লেজার, রোবট বা যেকোনো উপায়েই হোক না কেন।

টেনসরফ্লোকে ওপেন সোর্স বা উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম বলা যায়। গুগল সরে এলেও এটা নিশ্চয়ই ভাবার কোনো কারণ নেই, গুগলের সাহায্য ছাড়া পেন্টাগন নিজে সাধারণ ইমেজ প্রসেসিং প্রকল্প চালাতে বা ব্যবস্থাপনা করতে পারবে না। মার্কিন নৌবাহিনীর সাবেক এক সদস্য দ্য নেক্সট ওয়েব অনলাইনে তাঁর অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেছেন। তিনি নৌবাহিনীর তথ্য ব্যবস্থার কারিগরি বিভাগে কাজ করতেন। তিনি বলেন, পেন্টাগনের সামরিক ও বেসামরিক বিভাগের কম্পিউটার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। তিনি দেখেছেন, টেনসরফ্লো নিয়ে কাজ করতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর দক্ষতা অকল্পনীয়।

প্রশ্ন হচ্ছে, পেন্টাগন নিজেই যদি সব পারে, তবে বাইরের কোম্পানিকে কেন কাজ দেয়? আসলে, সরকার সব সময় ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে কাজ করে—এ প্রথা নতুন নয়। গুগলের সঙ্গে পেন্টাগনের কাজ নিয়ে তাই তেমন কথা শোনা যায়নি বা কেউ আপত্তি করেনি। কিন্তু মানুষের ভয়ের জায়গাগুলোর সমাধান না করেই, তারা এমন কিছু করছে যা দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ম্যাভেন প্রকল্পের নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোতে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু কোথাও এর প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে পরিষ্কারভাবে বলা হচ্ছে না। একটি বিষয় পরিষ্কার, শুধু ড্রোনের ফুটেজ সংগ্রহ করে তা কাজে লাগানোর জন্য এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। প্রাথমিক লক্ষ্য এটা করা হলেও এখন আর সেটা সেখানে আটকে নেই। একে প্রকৃতপক্ষে ‘অ্যালগরিদমিক ওয়্যারফেয়ার ক্রস-ফাংশনাল টিম’ বলা হয়। তাই এর কাজ শুধু গুগলের সাহায্যেই করা হবে—এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং গুগলকে দিয়ে মার্কিন সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এটি নিয়ে পরীক্ষা করানো হয়েছে। বেসরকারি খাতে তৈরি করা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সামরিক কাজে লাগালে তা কতটা কার্যকর হতে পারে—সেটিই দেখতে চেয়েছিল পেন্টাগন।

গুগল পেন্টাগনকে কতটুকু সহযোগিতা করেছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। তারা বলেছে, অস্ত্র তৈরির সঙ্গে তারা যুক্ত চায় না বলেই প্রতিষ্ঠানটির হাজারো কর্মী সোচ্চার হন। এক ডজনের বেশি কর্মকর্তা পদত্যাগ করেন।

অস্ত্র হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমান সফটওয়্যার তৈরি আর ছুরি তৈরি এক কথা নয়। যদিও দুটির ভালো বা মন্দ দিক আছে। তবে কাউকে খুন করার জন্য ছুরিকে প্রোগ্রাম করে রাখা যায় না। অর্থাৎ, কাউকে না কাউকে তা চালাতে হয়। তাই যুদ্ধবিগ্রহের অবস্থা বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও বেসামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে নৈতিক দায়িত্ব দেখাতে হবে। কিন্তু গুগল যেভাবে বড় প্রকল্পে নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাতে গুগলের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে।

মো. মিন্টু হোসেন: সাংবাদিক
[email protected]