'সাংসদ ছাড়াই' চার সিটি নির্বাচন!

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে রাজনীতির কোনো যোগ না থাকলেও এবার ঈদে ভোটের আগাম প্রচারণা যে জমে উঠেছিল, সেটি টের পাওয়া গেল রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ, মেয়র, কাউন্সিলর এবং সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীদের গণমুখী তৎপরতায়। আগে যেসব মন্ত্রী ও সাংসদ ঢাকায় ঈদ করতেন, এবার তাঁরাও নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় গিয়েছেন।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো নির্বাচনের আগে রাজনীতিকেরা ভোটারদের কাছে ভোটের জন্য ধরনা দেবেন, অনুনয়-বিনয় করবেন এবং নির্বাচনের পর তাঁদের কথা বেমালুম ভুলে যাবেন। আর নির্বাচনের পর সেই ভোটাররা এলাকায় তো নয়ই, ঢাকা শহরে এসেও মন্ত্রী-সাংসদদের একবার সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করবেন। জাতীয় নির্বাচনের কথা ভেবে মন্ত্রী-সাংসদ, সাবেক মন্ত্রী-সাবেক সাংসদ ও ভবিষ্যৎ পদপ্রার্থীরা নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে চেহারা মোবারক দেখিয়েছেন। ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের নামে তাঁরা ভোটারদের কাছে ভোটের জন্য আগাম ফরিয়াদ করেছেন।

আবার কোনো কোনো এলাকায় বিরোধী দলের নেতাদের সেই শুভেচ্ছা বিনিময় থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। তিন দিন মুদ্রণ সংস্করণ বন্ধ থাকায় এ রকমই একটি খবর বের হলো বিভিন্ন পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং সাবেক উপরাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী মওদুদ আহমদ ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়েছিলেন কোম্পানীগঞ্জে। কিন্তু পুলিশ নিরাপত্তার অজুহাত তুলে তাঁকে বাড়ি থেকে বেরই হতে দেয়নি। অগত্যা বিএনপির এই নেতাকে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় না করেই ঢাকায় চলে আসতে হয়। তাঁর অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং একই এলাকার সাংসদ ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে পুলিশ তাঁকে ঘর থেকে বের হতে দেয়নি। অবশ্য ওবায়দুল কাদের বলেছেন, গত নয় বছরে মওদুদ সাহেব এলাকায় জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। বিএনপি নেতার প্রতি পুলিশের আচরণ কিন্তু উল্টো বার্তাই দিচ্ছে।

এবার ঈদকে কেন্দ্র করে সারা দেশে ভোটের হাওয়া মৃদু ছন্দে বইলেও চার সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রচারণা ছিল জমজমাট। যেহেতু গাজীপুরে আগেই তফসিল ঘোষিত হয়েছিল, সেহেতু সেখানে দুই দলের মেয়র প্রার্থী (আওয়ামী লীগের জাহাঙ্গীর আলম ও বিএনপির হাসান সরকার) ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়টি পুরোপুরি নির্বাচনী প্রচারের কাজে লাগিয়েছেন। ২৬ জুন গাজীপুরে ভোট। অন্য তিন সিটি করপোরেশন বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেটে নির্বাচন হবে ৩০ জুলাই। ইসি ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দেওয়ার শেষ তারিখ ২৮ জুন। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই হবে ১ ও ২ জুলাই এবং প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ৯ জুলাই।

ইতিমধ্যে তিন সিটিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী নিয়ে নানা জল্পনা চলছে। তিন সিটিই বর্তমানে বিএনপির দখলে। বর্তমান মেয়ররাই দলের মনোনয়ন পাবেন, না নতুন কাউকে বেছে নেওয়া হবে—সে নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে ব্যাপক আলোচনা। খুলনায় সাবেক মেয়রকে বাদ দিয়ে বিএনপি নতুন প্রার্থী দিয়েছিল, যদিও তিনি জিততে পারেননি। গাজীপুরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই নতুন প্রার্থী দিয়েছে। আওয়ামী লীগ খুলনায় সাবেক মেয়রকে বেছে নিয়ে জিতিয়ে এনেছে। সিলেট ও রাজশাহীতে সাবেক মেয়র যথাক্রমে বদরউদ্দিন আহমদ কামরান ও খায়রুজ্জামান লিটনের প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু বরিশালে আওয়ামী লীগের শক্ত প্রার্থী নেই। বদলে যেতে পারে বিএনপির প্রার্থীও। বর্তমান মেয়র ‘বড় ভাইয়ের লোক’ হিসেবে পরিচিত। সিটি করপোরেশন কিংবা জাতীয় সংসদ—কোথাও প্রার্থী বাছাই বা মনোনয়নের কাজটি তৃণমূল থেকে হয় না। ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়।

সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের নানামুখী তৎপরতার মধ্যে খোদ নির্বাচন কমিশনেই ‘নীরব বিপ্লব’ হয়ে গেছে। বাংলাদেশে যেখানে সবকিছুতে ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হয়, ইসিতে সেখানে ‘না’ জয়যুক্ত হয়েছে। চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের প্রচারকাজে আর সাংসদেরা অংশ নিতে পারছেন না। গাজীপুরের বিষয়টি আগেই ফয়সালা হয়েছে। আগের আচরণবিধিতে নির্বাচনী প্রচারকাজে যাঁদের ওপর বিধিনিষেধ ছিল তাঁদের মধ্যে ছিলেন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং সিটি করপোরেশনের মেয়র। ২০১৩ সালের সংশোধনীতে সাংসদদেরও এই তালিকায় যুক্ত করা হয়।

গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে এইচ টি ইমামের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনের পদাধিকারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দাবি করে, সাংসদেরা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাভোগী নন। কোনো ক্ষমতা নেই। তাঁদের সিটি নির্বাচনের প্রচারকাজে অংশ নিতে দিতে হবে। একই সময় বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনে গিয়ে সিটি নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি তোলে। ইসি বিএনপির দাবি ‘রেওয়াজ নেই’ বলে সরাসরি নাকচ করে দিলেও আওয়ামী লীগের আরজি ফেলতে পারেনি। কমিশনের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং পক্ষে-বিপক্ষে মত আসে। সিইসিসহ চার কমিশনার সাংসদদের নির্বাচনী প্রচারে সুযোগ দেওয়ার পক্ষে মত দেন। কিন্তু কমিশনার মাহবুব তালুকদার দ্বিমত প্রকাশ করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেন। পরে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে তৈরি প্রস্তাবটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় ভেটিংয়ের জন্য। এই প্রস্তাবে বলা হয়, স্থানীয় সাংসদ নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে পারবেন না, অন্যরা পারবেন। ইসির চেষ্টা ছিল ক্ষমতাসীনদের খুশি করা; একই সঙ্গে নিজেদের ‘নিরপেক্ষ’ ভাবমূর্তিও ধরে রাখা। সে সময় প্রথম আলো শিরোনাম করেছিল, ‘ইসি এক কদম পিছু হটল।’ এরপর আইন মন্ত্রণালয় প্রস্তাবটি কমিশনে ফেরত পাঠায়, যাতে সব সাংসদের জন্য নির্বাচনে প্রচারের সুযোগ রাখা হয়।

১২ জুনের সভায় সেই প্রস্তাব নিয়ে কমিশনে আলোচনা হলেও তারা কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। এরপর আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৩ জুন তিন সিটি করপোরেশনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। ফলে সাংসদদের সিটি নির্বাচনের প্রচারে নামানোর উদ্যোগটি ভেস্তে যায়। এখন ইসি যদি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আচরণবিধি নিয়ে নতুন প্রজ্ঞাপন জারিও করে, তাতে বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারকাজে সাংসদেরা অংশ নিতে পারবেন না। তফসিল হওয়ার পর আগের আচরণবিধিতেই নির্বাচন করতে হবে।

প্রচারকাজে সাংসদদের অংশগ্রহণ ছাড়া যদি এতগুলো সিটি করপোরেশন নির্বাচন হতে পারে, তাহলে বাকিগুলো হতে বাধা কোথায়?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি